মধ্যপ্রাচ্যে উত্তেজনা চরমে, নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেয়া হলো খোমেনিকে হিজবুল্লাহ প্রধান নিহত

অগ্নিগর্ভ মধ্যপ্রাচ্য। যেন বারুদের উপর বসে আছে। সামান্য একটু টোকা  লাগলে যেকোনো সময় দাউ দাউ করে জ্বলে উঠবে। সে আগুনে পুড়বে বিশ্বও। শুক্রবার রাতে বিমান হামলায় ইসরাইল হত্যা করেছে লেবাননের যোদ্ধাগোষ্ঠী হিজবুল্লাহ’র প্রধান হাসান নাসরাল্লাহকে। এ সময় নিহত হয়েছেন ইরানের রেভ্যুলুশনারি গার্ডের ডেপুটি কমান্ডার আব্বাস নিলফোরুশান। নাসরাল্লাহর মৃত্যুতে তিন দিনের রাষ্ট্রীয় শোক ঘোষণা করেছে ইরাক। দেশটির প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মদ শিয়া আল সুদানি এ হত্যার নিন্দা জানিয়ে বলেছেন, ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী লাল রেখা অতিক্রম করেছেন। একে তিনি অপরাধ ও লজ্জাজনক হামলা বলে আখ্যায়িত করেন। উত্তেজনা চরম আকার ধারণ করায় ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলি খোমেনিকে নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেয়া হয়েছে। তবে তিনি ইসরাইলের নৃশংসতার নিন্দা জানিয়েছেন। হাসান নাসরাল্লাহ নিহত হওয়ার খবর নিশ্চিত করে বিবৃতি দিয়েছে হিজবুল্লাহ। তারা বলেছে, গাজা-ফিলিস্তিনকে সমর্থন করে, লেবাননের প্রতিরক্ষাকে সমর্থন করে শত্রুদের বিরুদ্ধে জিহাদ অব্যাহত রাখবে হিজবুল্লাহ। নিহত হাসান নাসরাল্লাহকে তারা শহীদ আখ্যা দিয়ে তার প্রতি অকৃত্রিম শ্রদ্ধা প্রদর্শন করছে। এ পরিস্থিতিতে লেবানন ও ইসরাইলের আকাশসীমা এক মাস এড়িয়ে চলতে বিমান সংস্থাগুলোকে নির্দেশ দিয়েছে ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন। হাসান নাসরাল্লাহকে হত্যার নিন্দা জানিয়েছেন তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তায়্যিপ এরদোগান। তিনি ইসরাইলকে থামামে পদক্ষেপ নিতে জাতিসংঘের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। ইয়েমেনে শোক প্রকাশ করছে হুতি বিদ্রোহীরা। তারা বলেছে, এই হত্যার মধ্য দিয়ে প্রতিরোধ আন্দোলন ভেঙ্গে দেয়া যাবে না। উল্টো আন্দোলন আরও বেগবাগ হবে।

উদ্ভূত পরিস্থিতিতে আঞ্চলিক উত্তেজনা চরম আকার ধারণ করেছে। তা বিভিন্ন আকারে প্রকাশ পেতে পারে বলে মন্তব্য করেছেন ইস্তাম্বুল জাইম ইউনিভার্সিটির সেন্টার ফর ইসলাম অ্যান্ড গ্লোবাল অ্যাফেয়ার্সের পরিচালক সামি আল আরিয়ান। তিনি বলেন, আঞ্চলিক পর্যায়ে যুদ্ধ শুরু হয়ে যেতে পারে। তার অংশ হতে পারে ইরান। প্রতিশোধ নিতে লেবানন, ইয়েমেন, ইরাক ও অন্য স্থান থেকে হামলা হতে পারে। তিনি মনে করেন দৃশ্যত ইসরাইল একটি যুদ্ধ চাইছে। বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের কয়েক সপ্তাহ আগে। এর মধ্যদিয়ে সেই যুদ্ধে তারা যুক্তরাষ্ট্রকে টেনে আনতে চাইছে। ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুকে যুক্তরাষ্ট্র সহ কোনো শক্তিধর দেশই থামাতে পারেনি বলে জাতিসংঘে শুক্রবার অনুশোচনা প্রকাশ করেছেন ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের পররাষ্ট্র বিষয়ক প্রধান জোসেপ বোরেল। একই দিন জাতিসংঘে অস্ট্রেলিয়া বলেছে, লেবাননকে আরেকটি গাজা হতে দেয়া যাবে না।
ওদিকে হাসান নাসরাল্লাহ নিহত হওয়ার পর হিজবুল্লাহ’র হাল কে ধরবেন তা নিয়ে আলোচনা শুরু হয়েছে। বলা হচ্ছে, মায়ের দিক থেকে কাজিন হাশিম সাফি আল দিন হতে পারেন তার উত্তরসূরি। তার জন্ম ১৯৬৪ সালে লেবাননের দক্ষিণে দিয়ের কানুন এন নাহরে। তিনি একজন প্রথম সারির শিয়া নেতা। হিজবুল্লাহ’র সিনিয়র কর্মকর্তা। এর আগে তিনি হিজবুল্লাহ’র সেক্রেটারি জেনারেল ছিলেন। সংগঠনে তাকে সেকেন্ড ইন কমান্ড হিসেবে ভাবা হতো। তার ভাই আবদাল্লাহ সাফি আল দিন ইরানে হিজবুল্লাহ’র প্রতিনিধিত্ব করেন। হাশিম সাফি আল দিন পড়াশোনা করেছেন নাজাফ, ইরাক এবং ইরানের কোম নগরীতে। নাসরাল্লাহর পাশাপাশি তিনি পড়াশোনা করেছেন। লেবাননে ফিরেছেন ১৯৯৪ সালে। দ্রুত হিজবুল্লাহ’র উপরের র‌্যাংকে উঠে যান। যোগ দেন মজলিস আল শূরায়। এরপর অল্প সময়ের মধ্যে জিহাদ কাউন্সিলের প্রধান নিযুক্ত করা হয়।

জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে যখন বিশ্বনেতারা শান্তির পক্ষে এবং যুদ্ধের বিপক্ষে কথা বলছিলেন, তখন শুক্রবার রাতভর লেবাননে ভয়াবহ হামলা চালায় ইসরাইল। এই হামলায় হাসান নাসরাল্লাহ নিহত হয়েছেন। ইসরাইলের দাবি, হাসান নাসরাল্লাহর সঙ্গে আলি কারাকি সহ বেশ কয়েকজন সিনিয়র নেতাও নিহত হয়েছেন। হিজবুল্লাহ’র দক্ষিণ ফ্রন্টের কমান্ডার আলি কারাকি। এর আগে ইসরাইল দাবি করে তারা লেবাননে হামলা চালিয়ে হিজবুল্লাহ প্রধান হাসান নাসরাল্লাহকে হত্যা করেছে। একে তারা বড় বিজয় হিসেবে দেখছে। এ খবর দিয়ে অনলাইন আল জাজিরা, বিবিসি বলছে, লেবাননে ইসরাইল আরও সেনা পাঠাচ্ছে। তারা লেবাননের ভেতরে স্থল পথে আগ্রাসন চালাতে পারে। উল্লেখ্য, গত বছর ৭ই অক্টোবর থেকে গাজায় যুদ্ধ শুরু করে ইসরাইল। তারপর থেকেই ইসরাইল এবং হিজবুল্লাহ’র মধ্যে পাল্টাপাল্টি যুদ্ধ চলছিল। হিজবুল্লাহ ইসরাইলের ভেতরে রকেট হামলা চালিয়েছে। তার জবাবে লেবাননের ভেতরে হিজবুল্লাহ’র অবস্থান লক্ষ্য করে ব্যাপক বোমা হামলা চালায় ইসরাইল। কিন্তু গত সোমবার থেকে ইসরাইল কঠোর অবস্থানে গিয়ে বেপরোয়াভাবে হামলা চালাচ্ছে লেবাননের ভেতরে। শুক্রবার রাতভর সেখানে ভয়াবহ বোমা হামলা চালিয়েছে তারা। শনিবারও হামলা অব্যাহত ছিল। শনিবার সকালেও তারা ইসরাইলের ভেতরে রকেট হামলা চালিয়েছে। আরও দক্ষিণে টার্গেট করেছে। কিন্তু ভয়াবহ এক অনির্দিষ্ট সময় এখন। একই সঙ্গে বিপজ্জনক। লেবাননে যেভাবে হামলা চালিয়েছে ইসরাইল, তা গাজার যুদ্ধের চিত্রকে সামনে নিয়ে আসে। একইভাবে তারা লেবাননে বাছবিচার না করেই বোমা হামলা চালাচ্ছিল। ইসরাইল ডিফেন্স ফোর্সেসের (আইডিএফ) প্রধান লেফটেন্যান্ট জেনারেল হারজি হ্যালেভি ৬২ সেকেন্ডের একটি সম্পাদিত ভিডিও বার্তায় বলেছেন, দীর্ঘ প্রস্তুতির পর ইসরাইলি সেনাবাহিনী লেবাননে (হাসান) নাসরাল্লাহ ও হিজবুল্লাহ’র প্রধান কার্যালয়ে টার্গেট করে হামলা চালিয়েছে। এটাই ছিল সঠিক সময়। আমরা এটা করেছি খুব মূল্যবান উপায়ে। এটাই আমাদের টুলবক্সের শেষ নয়। আমাদেরকে খুব পরিষ্কার হতে হবে। সামনে অগ্রসর হওয়ার আরও সক্ষমতা আছে আমাদের। তিনি আরও বলেন, মেসেজ ইজ ভেরি ক্লিয়ার। যে বা যারাই ইসরাইলি নাগরিকদের হুমকি দেবে আমরা জানি তাদেরকে কীভাবে শায়েস্তা করতে হয়। হোক সেটা উত্তরে, দক্ষিণে বা দূরে কোথাও।
শুক্রবার রাতভরও বেপরোয়া হামলায় ধ্বংসস্তূপের নিচে কি পরিমাণ মানুষ আটকে আছেন, কতোজনের মৃতদেহ তার নিচে চাপা পড়ে আছে, তা কেউ বলতে পারছেন না। এর মধ্যে আছে শিশু, নারী ও প্রবীণরা। সোমবার হামলা শুরুর পর থেকে কমপক্ষে ৭০০ মানুষ নিহত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। তবে এ সংখ্যা একেবারে সঠিক নয়। জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে ফিলিস্তিনি প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মদ মুস্তাফা ইসরাইলকে একটি দুর্বৃত্ত রাষ্ট্র হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। তিনি বলেছেন, গাজায় যুদ্ধাপরাধ, পশ্চিমতীর দখল করে রাখা এবং লেবাননের জনগণের বিরুদ্ধে যুদ্ধের জন্য অবশ্যই তাদের জবাবদিহি নিশ্চিত করা উচিত। গত বছর ৭ই অক্টোবর থেকে ইসরাইলের ভয়াবহ হামলায় গাজায় নিহতের সংখ্যা ৪১,৫৩৪ ছাড়িয়ে গেছে। এর মধ্যে লেবাননে সম্ভাব্য স্থল আগ্রাসন চালাতে ইসরাইলের উত্তরাঞ্চলে গত সপ্তাহের শুরুর দিকে দুই ব্যাটালিয়ন সেনা পাঠিয়েছে ইসরাইল। সর্বশেষ সেন্ট্রাল কমান্ড ডিফেন্সকে আরও শক্তিশালী করতে তারা আরও রিজার্ভ তিনটি ব্যাটালিয়ানকে পাঠিয়েছে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন লেবাননে ইসরাইলের স্থল হামলার বিষয়ে সতর্ক করেছেন। তিনি বলেছেন, স্থল হামলা থেকে বিরত থাকা উচিত ইসরাইলের। কারণ, এই যুদ্ধ তাহলে পুরো মধ্যপ্রাচ্যে ছড়িয়ে পড়তে পারে। এমনকি তা আরও বৃহত্তর রূপ নিতে পারে। ইসরাইলি সেনাবাহিনী বলেছে, লেবাননের বেকা ভ্যালিতে যোদ্ধাগোষ্ঠী হিজবুল্লাহ’র কয়েক ডজন অবস্থানস্থলকে টার্গেট করেছে তাদের যুদ্ধবিমান। এ ছাড়া দক্ষিণ লেবাননে বিভিন্ন এলাকায় হামলা চালিয়েছে। হামলা অব্যাহত আছে। কিন্তু লেবানন থেকে আল- জাজিরার সাংবাদিক বলছেন, হামলা হচ্ছে বেসামরিক জনগণের বসবাস আছে এমন ভবনগুলোতে। অন্যদিকে ইসরাইলের দাবি এসব ভবনে হিজবুল্লাহ অস্ত্র গুদামজাত করে রেখেছে। শুক্রবার রাতে এবং এর পরে যেসব হামলা হয়েছে তাতে কি পরিমাণ মানুষ হতাহত হয়েছেন তা জানা যায়নি। শনিবার সকালেও ভয়াবহভাবে যুদ্ধবিমান থেকে হামলা চালানো হচ্ছিল। অন্যদিকে হিজবুল্লাহ’র হাতে ইসরাইলি সেনাদের মতো অত্যাধুনিক অস্ত্র নেই। তারা  টেলিগ্রাম চ্যানেলে দেয়া বিবৃতিতে বলেছে, ইসরাইলে তারা দুটি হামলা করেছে। তারা বলেছে, ইসরাইলের দক্ষিণ-পূর্বের শহর হাইফা থেকে প্রায় ২০ কিলোমিটার দূরে রামাত ডেভিড এয়ারবেজের ওপর একটি ফাদি-৩ ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়েছে। ইসরাইলি মিডিয়ায় বলা হয়েছে, হাইফাকে ঘিরে থাকা দুটি শহরে আকাশ থেকে সাইরেন বাজানো হয়। অন্যদিকে লেবাননের বেকা ভ্যালি থেকে আল-জাজিরার সাংবাদিক আসাদ বেগ বলেন, হিজবুল্লাহ’র শক্ত ঘাঁটি হিসেবে বিবেচনা করা হয় বেকা ভ্যালিকে। ফলে সবার দৃষ্টি এখন সেদিকে। পূর্বাঞ্চলীয় এবং পশ্চিমাঞ্চলীয় পাহাড়ি এলাকার মধ্যবর্তী স্থানে অবস্থান বেকা ভ্যালির। এর পাশেই রয়েছে সিরিয়া। ধারণা করা হয়, হিজবুল্লাহকে সিরিয়া অস্ত্র সরবরাহ দিয়ে থাকতে পারে।

ইসরাইলের হামলায় লেবাননে ভয়াবহ ক্ষয়ক্ষতি হলেও ইউনিভার্সিটি অব তেহরানের প্রফেসর মোহাম্মদ মারান্দি বলেন, হিজবুল্লাহকে সামরিকভাবে পরাজিত করার সক্ষমতা নেই ইসরাইলের। কারণ, সারা দেশে মাটির নিচ দিয়ে তাদের আছে হাজার হাজার কিলোমিটার টানেল। তাদের অবকাঠামো নিরাপদ। তাদের সেনারা প্রস্তুত। হিজবুল্লাহ’র সবচেয়ে দুর্বল জায়গা হলো বৈরুত। কারণ, সেখানে পশ্চিমা সব দেশের দূতাবাস, এনজিও অফিস। তার মতে, এর মধ্যদিয়ে ইসরাইলিরা শুধু নিজেদের ধ্বংস করছে না। সামষ্টিকভাবে পশ্চিমাদেরও ধ্বংস করছে।

যে অস্ত্র ব্যবহার করা হয়েছে লেবাননে: ইসরাইলি মিডিয়ার খবরে বলা হচ্ছে কথিত বাংকার ধ্বংসকারী প্রায় ৮৫টি বোমা ব্যবহার করেছে ইসরাইলি সেনারা। এসব বোমা মাটি ভেদ করে অনেকটা ভেতরে প্রবেশ করে যেতে পারে। অনেকটা মাটির গভীরে গিয়ে তারপর বিস্ফোরিত হয় এই বোমা। মাটির নিচে থাকা স্থাপনা বা কোনো কংক্রিটের ভবনকে ধ্বংস করার ক্ষমতা আছে এর। প্রতিটি বোমার ওজন ২০০০ থেকে ৪০০০ পাউন্ডের মধ্যে। এই বোমা কংক্রিট ভেদ করে ৬ মিটার অথবা মাটি ভেদ করে ৩০ মিটার নিচে চলে যেতে পারে। তারপর বিস্ফোরিত হয়ে প্রচণ্ড কম্পন সৃষ্টি করে। তাতে ধসে পড়ে অবকাঠামো। ঘনবসতিপূর্ণ এলাকাগুলোতে এই বোমা ব্যবহার নিষিদ্ধ করেছে জেনেভা কনভেনশন।

সর্বশেষ