৫০০ কোটি টাকার সার আত্মসাৎ কাগজে মজুত বাস্তবে নেই

বিসিআইসির তদন্ত প্রতিবেদন: কতিপয় কর্মকর্তা-কর্মচারী, পরিবহণ ঠিকাদার ও গুদাম ইনচার্জ নানা কৌশলে গায়েব করেছে ৯১ হাজার ৬৯৭ টন

কাগজে-কলমে ৫০০ কোটি টাকা মূল্যের ইউরিয়া সারের মজুত থাকলেও এর অস্তিত্ব মেলেনি গুদামে। পরিবহণ ঠিকাদার, বাফার গুদাম ইনচার্জ ও বিসিআইসির কতিপয় কর্মকর্তা-কর্মচারী নানা কৌশলে ৯১ হাজার ৬৯৭ টন সার আত্মসাৎ করেছে। এর মধ্যে পরিবহণ ঠিকাদার ৬৬ হাজার টন ইউরিয়া গায়েব করেছেন। গুদামে পৌঁছে না দিয়েই সরবরাহ দেখিয়েছেন খাতা-কলমে। এছাড়া পটুয়াখালীর বাফার গুদাম ইনচার্জ সাদা কাগজে রিসিভ দেখিয়ে লোপাট করেন ২৩৮৭ টন সার। খোদ যমুনা সার কারখানার গুদাম থেকে গায়েব হয়েছে ১৯ হাজার টন সার। বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ করপোরেশনের (বিসিআইসি) তদন্ত প্রতিবেদনে উঠে আসে ভয়ংকর দুর্নীতির এমন চাঞ্চল্যকর তথ্য। শুধু এসব অনিয়মের ওপর সরকারের নিরীক্ষা অফিসও তদন্ত করেছে। সেখানেও সার আত্মসাতের একই চিত্র পাওয়া গেছে।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বিসিআইসির চেয়ারম্যান মো. সাইদুর রহমান রোববার জানান, বাফার গুদামে যে পরিমাণ সারের অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি সেটিই তদন্ত প্রতিবেদনে তুলে ধরা হয়েছে। দায়ীদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য মামলা করা ছাড়াও দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদকে) পাঠানো হয়েছে। দুদকের তদন্ত করে অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় এফআইআর দায়ের করা হয়েছে।

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল অব বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান জানান, বিগত কর্তৃত্ববাদী সরকারের দুর্নীতির একটি ছোট দৃষ্টান্ত মাত্র। দুর্নীতি ও অনিয়মের মাধ্যমে কর্তৃত্ববাদী যে বিকাশ ঘটেছিল এ প্রতিষ্ঠানের একাংশ জড়িয়ে পড়েছে। এ প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা যারা এর সঙ্গে জড়িত শুধু তারাই নন, বিভিন্ন প্রভাবশালী মহলের সুরক্ষা ছাড়া এ সিস্টেম্যাটিক দুর্নীতি করা সম্ভব নয়। এক্ষেত্রে শুধু প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতি হয়েছে তা নয়, লাভবান হয়েছে যারা সুরক্ষা দিয়েছেন, ওইসব প্রভাবশালী মহলও। প্রত্যাশা করব-এ ঘটনায় প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িতদের শনাক্ত করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করা হবে। সুশাসন ও দুর্নীতি মুক্ত করার একটি বিশাল সুযোগ হয়েছে এই নতুন বাংলাদেশে। এখন এ ধরনের ঘটনায় কিছু দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা নিতে পারলে ভবিষ্যতের জন্য একটি বার্তা হিসাবে থাকবে।

বিসিআইসির প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, সরবরাহ পরিবহণ ঠিকাদার যে ৬৬ হাজার টন সার আত্মসাৎ করেছে, সে ব্যাপারে মের্সাস নবাব অ্যান্ড কোম্পানির বিরুদ্ধে একটি মামলা হয়েছে। আর যমুনা সার কারখানার গুদাম থেকে আত্মসাতের ঘটনায় বিভাগীয় তদন্ত চলছে। একইভাবে পটুয়াখালী বাফার গুদাম ইনচার্জের কাছে আত্মসাতের ঘটনার জবাব চাওয়া হয়।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, দেশে মোট ইউরিয়া সারের মোট চাহিদা ২৭ লাখ টন, টিএসপি সারের ৭ লাখ ৫০ হাজার টন, ডিএপি সারের ১৫ লাখ টন এবং এমওপি সারের চাহিদা সাড়ে ৯ লাখ টন। কিন্তু বিপুল পরিমাণ সার আমদানি-পরিবহণ ও গুদামজাতকরণ নিয়ে প্রতিবছরই ঘটছে নানা অনিয়ম। অথচ এই সার আমদানি করতে সরকারকে গুনতে হয় কয়েক মিলিয়ন ডলার। বর্তমান ডলার সংকটের কারণে সার আমদানিও ব্যাহত হচ্ছে।

বিসিআইসির তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২২ সালে পরিবহণ ঠিকাদার মের্সাস নবাব অ্যান্ড কোম্পানি সার চুক্তি মোতাবেক ৪ হাজার ৪৮২ টন ইউরিয়া সার গুদামে সরবরাহ না করে তা আত্মসাৎ করে। একইভাবে পৃথক লট ৬১ হাজার ৭২৬ টন ইউরিয়া সার গুদামে সরবরাহ করেনি। সার সরবরাহ নিয়ে প্রতিষ্ঠানটির সঙ্গে বিসিআইসির চুক্তি ছিল। সার পরিবহণ চুক্তির ক্লজ নং-৪(এ) অনুযায়ী পুরো কার্গো খালাসের জন্য পর্যাপ্ত বার্জ বা কোস্টার মোতায়েন করা এবং ৫০ দিনের মধ্যে ব্যাগযুক্ত সার গোডাউন বা কারখানায় পৌঁছে দেওয়ার কথা রয়েছে। কিন্তু অদ্যাবধি এই সার গুদামে পৌঁছায়নি। যার বাজার মূল্য পৌনে তিনশ কোটি টাকা। এর কোনো সুষ্ঠু জবাব মেলেনি প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে।

সূত্র আরও জানায়, প্রথম দফায় ৪ হাজার ৪৮২ টন সার নির্ধারিত সময়ে গুদামে পৌঁছায়নি সরবরাহকারী পরিবহণ ঠিকাদার মেসার্স নবাব অ্যান্ড কোম্পানি। কিন্তু সে ব্যাপারে কোনো পদক্ষেপ না নিয়ে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে পরিবহণ বিল বাবদ (চেক ভাউচার নং-১১৬৬ ও ১২০০) ১ কোটি ২২ লাখ টাকা বিল পরিশোধ করা হয়। এই বিল পাওয়ার পর পরিবহণ ঠিকাদার বিসিআইসির কতিপয় কর্মকর্তা-কর্মচারীর যোগসাজশে পরবর্তী সময়ে একই কায়দায় ৬৬ হাজার টন সার নির্ধারিত গুদামে পৌঁছে না দিয়ে আত্মসাৎ করেছে-মন্তব্য করা হয় বিসিআইসির তদন্ত প্রতিবেদনে।

এদিকে সরকারের সারের বাফার গুদামগুলোতে প্রকৃত মজুত বের করার জন্য তদন্ত কমিটি রয়েছে। ওই কমিটির বার্ষিক মজুতের পরিমাণ যাচাই-বাছাইকালে যমুনা সার কারখানার গুদামে ১৯ হাজার ১৩৩ টন সার কম পেয়েছে। এর মধ্যে এসএফসিএল সারের মজুত ১২১ টন পাওয়ার কথা থাকলেও সেখানে এক টন সারেরও সন্ধান পায়নি কমিটি। একইভাবে কাফকোর ১ হাজার ১১৩ টন সার মজুত থাকার কথা কিন্তু বাস্তবে ৯০ টন কম পেয়েছে। এছাড়া আমদানিকৃত সার ২ হাজার ৭০৮ টনের স্থলে গুদামে মিলছে ১ হাজার ৫০৮ টন, হদিস মেলেনি ১২০০ টন সারের। তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে দেখা গেছে, ব্যাগড সার ৩৭ হাজার ৫৭৮ টনের বিপরীতে অস্তিত্ব পেয়েছে ১৬ হাজার ২৬৪ টনের। বাকি ২১ হাজার ৩১ টন গায়েব হয়েছে। সেখানে আরও দেখা গেছে, লুজ সার ৫১ হাজার ৮৬৬ টন থাকার কথা কিন্তু বাস্তবে মিলছে মাত্র ২১৬ টন। ৫১ হাজার ৬৪৯ টন সার পাওয়া যায়নি।

বিপুল পরিমাণ সার অব্যবস্থাপনাজনিত ক্ষতি, ঝড় বৃষ্টি, কোনো দৈব দুর্বিপাকে ঘাটতি হতে পারে না বলে মন্তব্য করেছে তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে। সেখানে বলা হয়েছে উক্ত পরিমাণ সার আত্মসাৎ করা হয়েছে বলে প্রতীয়মান হয়েছে।

এদিকে গাইবান্ধা বাফার গুদামে বাস্তব সার গণনার বিষয়ে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, গুদামে মজুত ছিল ৫ হাজার ১৪৫ টন সার। কিন্তু যাচাই-বাছাইকালে পাওয়া গেছে ২ হাজার ৮০৩ টন। বাস্তবে মেলেনি ২ হাজার ৩৪৩ টনের।

আগের বছরে গুদামের সারের ঘাটতি থাকলেও সেটি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে অবহিত করা হয়নি। ফলে এই বিপুল পরিমাণ সার আত্মসাৎ করার সুযোগ করে দেওয়া হয়েছে বলেও উল্লেখ করা হয় প্রতিবেদনে।

সর্বশেষ ঘটনায় দেখা গেছে, পটুয়াখালীর বাফার গুদামের ইনচার্জ মো. হারুন উর রশিদ সাদা কাগজে স্বাক্ষর করে ২ হাজার ৩৮৭ টন সার আত্মসাৎ করেন। জানা গেছে, মের্সাস সাউথ ডেল্টা শিপিং অ্যান্ড ট্রেডিং লি. ২ হাজার ৪৫০ টন সার সরবরাহ করেন পটুয়াখালী বাফার গুদামে। এ সময় ইনচার্জ হারুন অর রশিদ ৬২.৫০ টন সারের মেটিরিয়াল রিসিভ রিপোর্ট (এমআরআর) দিয়েছেন। বাকি ২ হাজার ৩৮৭ টন সার রিসিভ করেছেন সাদা কাগজ এবং বোটনোটে। কিন্তু পরবর্তী সময়ে সাদা কাগজের স্বাক্ষর তার নয় বলে দাবি করেন হারুন অর রশিদ। বিষয়টি অধিক তদন্তের জন্য সিআইডির ফরেনসিক ল্যাবে টেস্টে প্রমাণ হয় স্বাক্ষরটি পটুয়াখালীর বাফার গুদাম ইনচার্জ হারুন অর রশিদের। ফলে তদন্তে বেরিয়ে আসে সাদা কাগজে স্বাক্ষর দিয়ে রিসিভ করা ২৩৮৭ টন সার এমআরআর হয়নি, গুদামেও প্রবেশ করেনি। অর্থাৎ এই সার আত্মসাৎ করা হয়েছে।

সর্বশেষ