টানা ভারি বর্ষণে দুর্ভোগ বিভিন্ন স্থানে জলাবদ্ধতা, বাসাবাড়িতে পানি

 

বরিশাল নগরীর গুরুত্বপূর্ণ সড়কে হাঁটুপানি * ফেনীতে বাঁধ ভেঙে মুহুরী নদীর পানি লোকালয়ে

টানা ভারি বর্ষণে চট্টগ্রাম, বরিশাল ও নোয়াখালীসহ বিভিন্ন স্থানে জনজীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। দেখা দিয়েছে জলাবদ্ধতা। অনেক জায়গায় সরকারি অফিস ও বাসাবাড়িতেও পানি ঢুকে পড়েছে। এতে চরম দুর্ভোগে পড়েছেন বাসিন্দারা। বিশেষ করে দিনমজুর ও ভ্যান-রিকশা চালকদের সীমাহীন কষ্ট পোহাতে হয়েছে। বঙ্গোপসাগরে গভীর সঞ্চালনশীল মেঘমালা তৈরি হওয়ায় মোংলাসহ তিন সমুদ্রবন্দরকে ৩ নম্বর সতর্ক সংকেত দেখাতে বলেছে আবহাওয়া অধিদপ্তর। মোংলায় টানা বর্ষণের কারণে ৩ দিন ধরে জাহাজে পণ্য খালাস বন্ধ রয়েছে। বরিশাল নগরীর গুরুত্বপূর্ণ সড়কে জমেছে হাঁটুপানি। নোয়াখালীতে ২৪ ঘণ্টায় রেকর্ড বৃষ্টিপাত হয়েছে। ফেনীতে পাহাড়ি ঢলে মুহুরী নদীর বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের তিন স্থানে ভেঙে লোকালয়ে পানি প্রবেশ করেছে। ব্যুরো ও প্রতিনিধিদের পাঠানো খবর-

বরিশাল : নগরীর প্রধান সড়ক সদর রোড, সাংবাদিক মাইনুল হাসান সড়ক, গির্জামহল্লা, কাকলীর মোড়, হাসপাতাল রোড, বটতলা এলাকা, শ্রীনাথ চ্যাটার্জি লেন, রূপাতলী হাউজিং সড়ক, কলেজ অ্যাভিনিউ, কালীবাড়ি রোড, বগুড়া রোড, শীতলা খোলা, মুন্সি গ্রেজ, কলেজ রোড, বৈদ্যপাড়া, কাউনিয়া ও পলাশপুরের বিভিন্ন সড়কে জলাবদ্ধতা দেখা দিয়েছে। এসব এলাকা বাদেও নগরীর অন্যান্য নিম্নাঞ্চলে পানি জমেছে। নগরীর পলাশপুর, রসুলপুর, মোহাম্মদপুর, বেলতলা, রূপাতলী হাউজিংসহ আশপাশের এলাকা, শ্রীনাথ চ্যাটার্জি লেন, কলেজ অ্যাভিনিউসহ একাধিক এলাকার বাসিন্দারা পানিবন্দি। তারা পরিবার-পরিজন নিয়ে ঘরবন্দি অবস্থায় চরম দুর্ভোগে দিন কাটাচ্ছেন। এসব এলাকার অধিকাংশ ঘরে পানি প্রবেশ করেছে বলে জানিয়েছেন ভুক্তভোগীরা।

বটতলা এলাকার বাসিন্দা জহিরুল ইসলাম বলেন, এ এলাকার দুর্ভোগ কোনো দিনও শেষ হবে না। বৃষ্টি হলেই হাঁটু বা কোমরপানি জমে। আরও গভীর ড্রেন নির্মাণ করা না হলে এমন দুর্ভোগ আজীবন পোহাতে হবে।

বরিশাল আবহাওয়া অফিসের উচ্চপর্যবেক্ষক মাসুদ রানা রুবেল বলেন, ৩ দিন ধরে ভারি বৃষ্টি হচ্ছে। শুক্রবার বেলা ৩টার আগের ৫৭ ঘণ্টায় ২১৩.৪ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে।

চট্টগ্রাম : ভারি বৃষ্টিতে বৃহস্পতিবার নগরীর বিভিন্ন স্থানে জলাবদ্ধতা দেখা দেয়। শুক্রবার সন্ধ্যা পর্যন্ত সেই বৃষ্টি অব্যাহত ছিল। তবে এদিন হালকা থেকে মাঝারি ধরনের বৃষ্টি হওয়ায় আগের দিনের মতো জলাবদ্ধতা দেখা যায়নি। কিছু কিছু এলাকায় সকালের দিকে পানি উঠলেও অল্প সময়ের মধ্যেই নেমে যায়। এদিকে বৃষ্টির কারণে স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে গণপরিবহণ কম থাকায় ভোগান্তি পোহাতে হয়েছে নাগরিকদের। বিভিন্ন সড়কে খানাখন্দে পানি জমে যায়। ফলে পানি ও কাদা মাড়িয়ে কাকভেজা হয়ে চলাচল করতে হয়েছে পথচারীদের। জুমার নামাজের আগে পরেও বৃষ্টি হয়। অনেক মুসল্লিকে বৃষ্টিতে ভিজে মসজিদে যেতে দেখা গেছে।

মোংলা (বাগেরহাট) : মোংলা বন্দরের হার্বার বিভাগ জানায়, টানা বৃষ্টির কারণে ৩ দিন ধরে বন্দরে পাঁচটি বিদেশি জাহাজ থেকে খাদ্যপণ্য ও সার খালাস বন্ধ রয়েছে। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন বন্দর ব্যবহারকারীরা। স্থানীয় শিপিং এজেন্ট রেনু শিপিংয়ের সহকারী ব্যবস্থাপক কাজী মাহাবুবুল হক শুভ জানান, ১ জুলাই বন্দরের হারবাড়িয়া ৫ নম্বর বয়ায় ২১ হাজার ৮০০ টন গম নিয়ে ‘এমভি প্রটেক্টর এসটি রাফায়েল’ এবং ১৬ জুলাই ২২ হাজার টন গম নিয়ে ‘এমভি এলিন কারেজ’ হারবাড়িয়া ৬ নম্বর বয়ায় অবস্থান নেয়। বুধবার থেকে ভারি বৃষ্টি হওয়ায় এই দুটি জাহাজ থেকে গম খালাস বন্ধ রাখা হয়েছে। মোংলা পৌর মেয়র বীর মুক্তিযোদ্ধা শেখ আব্দুর রহমান বলেন, বৃষ্টিতে মোংলা পৌর শহরের বিভিন্ন এলাকায় জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়েছে।

উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান জামাল হোসেন জানান, বৃষ্টি ও জোয়ারের পানিতে শতাধিক চিংড়ি ও মৎস্য খামার ভেসে গেছে। মোংলা আবহাওয়া অধিদপ্তরের ইনচার্জ হারুন অর রশিদ জানান, ২৪ ঘণ্টায় মোংলা বন্দরসহ সুন্দরবন উপকূলে প্রায় ২৫০ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে।

বেগমগঞ্জ (নোয়াখালী) : রেকর্ড বৃষ্টিতে পৌর শহরের প্রধান সড়কের একটি অংশ ছাড়া সব সড়ক ও এলাকায় জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়েছে। জেলার ৯টি উপজেলার কিছু নিম্নাঞ্চলেও জলাবদ্ধতা দেখা দিয়েছে। এতে দুর্ভোগে পড়েছেন লক্ষাধিক মানুষ। পানি ডুকে পড়েছে বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানেও। ভেসে গেছে কয়েকটি মাছের ঘের। অনেক বহুতল ভবনের নিচতলায় পানি ডুকে পড়ায় রান্নাবান্না ব্যাহত হচ্ছে।

আবহাওয়া অফিসের আবহাওয়া কর্মকর্তা মো. রফিকুল ইসলাম বলেন, জেলায় শুক্রবার দুপুর ১২টা পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় ২৭৭ মিলিমিটার বৃষ্টি রেকর্ড করা হয়েছে। ভারি বর্ষণের ফলে আমার অফিস ও সড়ক ডুবেছে। আমিও জলাবদ্ধতায় আটকে আছি।

সরেজমিন জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের নিচের কক্ষ, পুলিশ সুপারের কার্যালয়, জেলা আবহাওয়া অফিস, জেলা মৎস্য অফিস, প্রেস ক্লাব, রেডক্রিসেন্ট, বিআরডিবি, ম্যাটস্, বিদ্যুৎ অফিস, সাবরেজিস্ট্রি অফিসের রেকর্ডকক্ষ, শহীদ ভুলু স্টেডিয়াম, বন বিভাগের বাংলো, নোয়াখালী সরকারি কলেজ, মাইজদী সরকারি টেকনিক্যাল স্কুল অ্যান্ড কলেজে পানি দেখা গেছে। এছাড়া টাউন হল মোড়, ইসলামিয়া সড়ক, ডিসি সড়ক, মহিলা কলেজ সড়ক, জেলখানা সড়ক, মাইজদী বাজার সড়কসহ বিভিন্ন সড়ক কয়েক ফুট পানির নিচে তলিয়ে গেছে।

ফেনী ও দাগনভূঞা : টানা বৃষ্টি ও উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে মুহুরী নদীর বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের পরশুরামের শালধর পয়েন্ট ও ফুলগাজীর ২টি পয়েন্টে ভেঙে লোকালয়ে পানি ঢুকছে। শুক্রবার বিকালে বাঁধ ভেঙে দক্ষিণ শালধর, মালিপাথরসহ প্রায় ১০ গ্রামের নিচু এলাকা প্লাবিত হয়েছে। এদিকে টানা বর্ষণে দাগনভূঞা উপজেলার নিম্নাঞ্চলের অন্তত ১৫ গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। এসব গ্রামে বীজতলাসহ রাস্তাঘাট ও পুকুর ভেসে গেছে।

ভাটারা (ঢাকা) : ভাটারার ফাঁসেরটেকের মধ্যপাড়া এলাকায় জলাবদ্ধতা দেখা দিয়েছে। ভাটারার নয়ানগরের দোকানি লোকমান হোসেন বলেন, দোকানের সামনে পানি। ভেতরেও পানি চলে এসেছে। কাস্টমার আসার উপায় নেই। সকালে দোকান খুলেছি, কিন্তু কাস্টমারের দেখা নেই।

চাঁদপুর : বুধবার দুপুর থেকে চাঁদপুরে মুষলধারে বৃষ্টি শুরু হয়। থেমে থেমে বৃষ্টি অব্যাহত ছিল শুক্রবারও। বৃহস্পতিবার সকাল ৯টা থেকে শুক্রবার দুপুর ১২টা পর্যন্ত জেলায় ১০৭ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে। টানা বৃষ্টির কারণে চাঁদপুর শহরের বেশ কয়েকটি সড়ক পানিতে তলিয়ে গেছে। বিশেষ করে আবাসিক এলাকার সড়কগুলোর অবস্থা বেহাল।

বান্দরবান : দুপুর ১২টা থেকে জেলায় টানা ভারি বৃষ্টিপাত হয়েছে। পাহাড়ের পাদদেশে ঝুঁকিপূর্ণ বসবাসকারীদের নিরাপদ আশ্রয়ে সরে যেতে প্রশাসন, ফায়ার সার্ভিস, পৌরসভার পক্ষ থেকে মাইকিং করা হয়েছে। বান্দরবানের জেলা প্রশাসক শাহ মোজাহিদ উদ্দিন জানান, পাহাড় ধসে বিচ্ছিন্ন হওয়া থানচি-আলীকদম সড়ক যোগাযোগ ফের চালু হয়েছে। আবহাওয়া অধিদপ্তর জানায়, ৬ ঘণ্টায় বান্দরবানে ৭২ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে।

রায়পুর (লক্ষ্মীপুর) : দুই দিনের টানা বৃষ্টিতে জলাবদ্ধতা দেখা দিয়েছে। শহরের প্রধান সড়ক, নতুন বাজার থেকে মহিলা কলেজ সড়ক, খাজুরতলা সড়ক, টিএনটিসহ বেশিরভাগ সড়কই পানির নিচে। পানি ঢুকেছে বাসাবাড়ি ও দোকানপাটে।

মীরসরাই (চট্টগ্রাম) : ৩ দিন ধরে প্রবল বর্ষণ ও পাহাড়ি ঢলে তলিয়ে গেছে বিভিন্ন ইউনিয়নের রাস্তাঘাট, ঘরবাড়ি ও ফসলি জমি।

চিতলমারী (বাগেরহাট) : জোয়ার ও দুই দিনের ভারি বৃষ্টিতে উপজেলার বিভিন্ন স্থানে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়েছে। তলিয়ে গেছে নিম্নাঞ্চল।

রাজশাহী : জেলায় টানা বৃষ্টিতে স্বস্তি পেয়েছেন আমন চাষিরা। বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিএমডিএ) গভীর নলকূপ থেকে সেচের পানি না কিনে আমনের চারা রোপণ বা আগাছা পরিষ্কারের কাজ করতে পারছেন তারা। এতে চাষিদের খরচ কমেছে। এদিকে গোদাগাড়ীতে পদ্মায় ভেসে গেছে ১৫ জেলের জাল ও নৌকা।

খাগড়াছড়ি : দুই দিনের ভারি বর্ষণ ও চেঙ্গী নদীর ঢলে পানিবন্দি হয়ে পড়েছে শতাধিক পরিবার। শুক্রবার ভোর থেকে খাগড়াছড়ি সদরের মুসলিমপাড়া, মেহেদীবাগ, কালাডেবা, গঞ্জপাড়া, ঠাকুরছড়াসহ চেঙ্গী পাড়ের নিম্নাঞ্চলের বসতবাড়িতে পানি ঢুকে পড়ে। এদিকে সড়ক ডুবে যাওয়ায় সাজেক ও লংগদুতে যান চলাচল বন্ধ হয়ে গেছে।

সর্বশেষ