নগর চাষাবাদ – হতে পারে মৌলিক চাহিদার যোগানদাতা

ঢাকা শহরেই উন্মুক্ত ছাদের পরিমান প্রায় সাড়ে চার লক্ষ। প্রত্যেক বাড়ির বারান্দা হিসাব করলে উন্মুক্ত বারান্দা পাওয়া যাবে প্রায় ৫০ লক্ষ। অন্যদিকে, কাচামরিচের কেজি ১ হাজার টাকা। করলার কেজি ৮০ টাকা। এবং, ১ কেজি আনার ফলের দাম ৩৫০ টাকা। টমেটো এখন সিজনেই ১০০ টাকা কেজি। কি ভাবছেন? কেন টানছি এই প্রসঙ্গ, তাইতো? শুধুমাত্র পুষ্টির চাহিদা নয়, সৌন্দর্য্য বর্ধন, স্বাস্থ্য এবং অর্থনীতি, সহ অনেক সমস্যারই সমাধান টানা যাবে এই ছাদবাগানে।

ছাদবাগান বা শহুরে চাষাবাদ হচ্ছে, ভূমিবিহীন বা স্বল্প মাটির ব্যবহারে উন্মুক্ত পরিবেশে, টব বা ওই ধরনের পদ্ধতি ব্যবহারের মাধ্যমে টেকসই জলবায়ু নিশ্চিতের মাধ্যমে কৃষিকাজ সম্পাদন, যার মাধ্যমে, জলবায়ু সমস্যা নিরোধ, খাদ্য, পুষ্টি এবং অর্থনৈতিক চাহিদা মেটানো সম্ভব হয়।
কেন ছাদবাগান?
শহরে গ্রীষ্ম মৌসুমে ছাদ হতে নেমে আসা গরমে অতীষ্ট হয়ে এক খন্ড তাজা লেবু দিয়ে তৃষ্ণা নিবারন করতে ইচ্ছে হচ্ছে, কিন্তু, ঘরে লেবু নেই। নিজ ছাদেই উৎপাদন করলেন এই লেবু। খেলেন, তৃষনা মেটালেন। কেমন হবে ব্যাপারটা? শহরের প্রায় ৫০% গৃহিনী দিনের অধিকাংশ সময় অলস সময় কাটান। অলসতায় পড়ে শারীরিক কর্মক্ষমতা হারাচ্ছেন। দিনের ১ টি ঘন্টা আপনার ছাদে সময় দিন। বাগানে কাজ করুন। এতে সময়টাও ভালো যাবে, শরীর তাও চাঙ্গা থাকবে। বাজারের বিষাক্ত শাক সবজির পরিবর্তে নিজের হাতে উৎপাদিত সবজি দিয়ে রান্না করে পরিবারকে খাওয়ানোর জন্যে ছাদ বাগান প্রয়োজন। গ্রীষ্মকালীন তাপদাহে বাড়ির অতিরিক্ত গরম শোষণে সমাধান আনবে ছাদবাগান। অর্থনৈতিক সাশ্রয় সম্ভব ছাদবাগানের মাধ্যমেই।
যেসকল পন্য চাষ করবেন ছাদবাগানেঃ
ধারণা ছিল নগরে বা ছাদে একটু ছোট জাতের, ঝোপালো ফল-সবজি গাছ লাগানো ভালো, এই ধারণাকে ভুল প্রমাণ করেছে ১৫-২০ বছর যাবত ছাদ-বাগান করে আশা ব্যক্তি ও সংগঠনগুলো। নগরে এবং ছাদে কি হয় না, সব হয়-ছোট জাতের ভিয়েতনামিজ নারিকেল, সব জাতের আম, আমড়া, কামরাঙা, জাম, জামরুল, কদবেল, থাই ও মিসরীয় ডুমুর, আনার, ডালিম, লটকন, থাই লিচু, সিন্দুরী পেয়ারা আম, জাম, হলুদ এবং সাদা ড্রাগন ফল, বারোমাসি আম, বীজহীন লেবু, লাল স্ট্রবেরি পেয়ারা, লাল ইক্ষু, কমলা, বারি মাল্টা, অ্যাভোকেডো, রাম্বুটান ছাড়াও গতানুগতিক সব দেশি ফলতো এখন সাধারণ বিষয়। বীজ থেকে যে সকল ফল নগরবাসী গতানুগতিক চাষ করে তার মধ্যে করমচা, শরিফা, বিলিম্বি ইত্যাদি কয়েকটি ছাড়া প্রায় সবই কলমের ফল গাছ। আসলে এখন ছাদ-কৃষির কল্যাণে নগরবাসী সব ধরনের ফল গাছই চাষ করার আগ্রহ দেখাচ্ছে।
ছাদবাগানে কি কি সুবিধা পাওয়া সম্ভব?
ছাদবাগান ঘর রাখবে শীতল,
সরবরাহ করবে অক্সিজেন, যা বৈষ্ণিক জলবায়ু সমস্যা মোকাবেলায় আনবে সমাধান,
মেটাবে শাক সবজির চাহিদা,
ফলদ পুষ্টি সরবরাহে সুবিধা,
অর্থনৈতিক সাশ্রয় ও উন্নয়ন,
শারিরিক সুস্থ্যতা ও কায়িক শ্রম,
রোগব্যাধি হতে মুক্তি এবং মানসিক প্রশান্তি,
সৌন্দর্য বর্ধন এবং সামাজিক স্ট্যাটাস বৃদ্ধি।
ছাদবাগানে ফুল এবং সৌন্দর্য বর্ধক বৃক্ষ, রোপন, পরিচর্যা এবং বাজারজাতকরণের মাধ্যমে প্রচুর পরিমাণ নারী ও যুব উদ্যোক্তা তৈরি করা সম্ভব যা দেশীয় অর্থনীতিতে বিপ্লবী পরিবর্তন আনার পাশাপাশি বেকারত্ব সমস্যা অনেকটাই লাঘব করবে।
ছাদবাগানের সীমাবদ্ধতা
যদিও তথ্য দেওয়া সহজ, কিন্তু, প্রয়োগ সক্ষমতা কঠিন। ছাদবাগানের কিছু জটিলতা বিদ্যমান। ছাদ ব্যবহারে বাড়ির মালিকের অনুমতি না পাওয়া, ছাদের গাঠনিক স্থাপনা নষ্ট হওয়ার ভয় ছাদ বাগানকে অনেকটাই অনুৎসাহিত করছে। এছাড়াও, ছাদ বাগানে প্রয়োজনীয় পানি সরবরাহ করতে না পারাটাও একটা বাধা হতে পারে। তাও ছাদবাগান হতে পারে আধুনিকায়নের ফলে সৃষ্ট সামাজিক, পরিবেশগত এবং অর্থনৈতিক সমস্যার টেকসই সমাধান। উন্নত প্রযুক্তির ব্যবহার এবং পর্যাপ্ত প্রচারনাই নিশ্চিত করতে পারে নগর চাষাবাদের বিপ্লবী সম্ভাবনা।
ইনডোর চাষাবাদ প্রযুক্তিঃ
ঘরের অভ্যন্তরে বা বারান্দায় ফুল, ফল এবং সবজির চাষ হতে পারে একটা লাভজনক নগর চাষাবাদ প্রক্রিয়া। ছাদে যাদের চাষাবাদ করার সুযোগ হচ্ছেনা, তাদের জন্যে এই পদ্ধতিতে চাষাবাদ অনেকটাই ফলপ্রসু হবে। যদিও এক্ষেত্রে সকল ধরনের সবজি এবং পন্য চাষাবাদ করা সম্ভব নয়, কিন্তু অনেক ছোট ছোট গুল্ম উদ্ভিদ, ফুল গাছ এবং সৌন্দর্যবর্ধক লতার চাষ করা সম্ভব। এই চাষাবাদ প্রযুক্তি ঘরের সৌন্দর্য যেমন ভাবে বৃদ্ধি করবে, তেমনি মানসিক প্রশান্তি বৃদ্ধিতেও ইনহেলার হিসেবে কাজে দিবে।
নগর উলম্ব চাষাবাদ (ভার্টিক্যাল ফার্মিং);
চলমান শতাব্দীতে জনসংখ্যা বৃদ্ধির বিস্ফোরণের ফলে ১০ কোটি হেক্টর বেশি কৃষি জমির প্রয়োজন পড়বে এসব বাড়তি জনগোষ্ঠীর খাদ্য চাহিদা পূরণ করতে। যেহেতু আমাদের কৃষি জমি সুনির্দিষ্ট এবং দিনকে দিন এর আয়তন হ্রাস পাচ্ছে, এজন্যে এর বিকল্প হিসেবেই আমাদের উলম্ব চাষাবাদ প্রযুক্তি বা ভার্টিকাল ফার্মিং। উলম্ব চাষাবাদ প্রযুক্তি কোনোরুপ মাটির সাহায্য ছাড়াই চাষাবাদ করার প্রযুক্তি। এবং, আশ্চর্যজনক ভাবে প্রায় ৯৫% শতাংশ পানির ব্যবহারও কমানো সম্ভব এই প্রযুক্তিতে চাষাবাদের মাধ্যমে। উক্ত চাষাবাদ পদ্ধতিতে গবেষকদের প্রাপ্ত ধারণাঃ যদি ৩০ তলা সুউচ্চ ভবনকে ভার্টিকাল ফার্মিং এর আওতায় আনা যায়, তবে প্রায় ২৭,৮০০০,০০০ বর্গমিটার ভার্টিকালি চাষাবাদ করা সম্ভব এবং এক্ষেত্রে, প্রাপ্ত পন্য দিয়ে প্রায় অর্ধ লক্ষ মানুষের খাবারের চাহিদা মেটানো সম্ভব। যদিও ছাদবাগান চাষাবাদ ব্যবস্থা বাংলাদেশে কিছুটা পরিচিতি পেয়েছে, তবে সর্বাধুনিক টেকসই কৃষি ব্যবস্থা হতে পারে এই ভার্টিকাল ফার্মিং। সরকার এবং সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের সুনজর এবং প্রয়োজনীয় পদক্ষেপের মাধ্যমে এই কৃষি প্রযুক্তি নিশ্চিত করতে পারলে দেশে খাদ্য সংকট অনেকটাই লাঘব হবে, এবং বনায়ন হ্রাসে সৃষ্ট জলবায়ু সমস্যার টেকসই সমাধান নিশ্চিত হবে।

লেখকঃ সাখাওয়াত হোসেন সাকিব,
শিক্ষার্থী- এনভায়রনমেন্টাল এন্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ,
জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়।

সর্বশেষ