চরমোনাই পীরের নেতৃত্বাধীন ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ আসন্ন পাঁচ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে দলীয় প্রার্থী ঘোষণা করেছে। বিগত কয়েক বছর ধরে স্থানীয় সরকার নির্বাচনে আস্তে আস্তে উন্নতি করা দলটি এবারের পাঁচ সিটি নির্বাচনে আরও ভালো করতে চায়। বিশেষ করে তাদের ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত বরিশালে তারা বড় চমক দেখাতে চায়। বিএনপি নির্বাচনে অংশ না নেওয়ায় তারাই হয়ে উঠতে চায় ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ প্রার্থীর প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী।
গত বৃহস্পতিবার (২৭ এপ্রিল) বরিশাল সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের সিনিয়র নায়েবে আমির মুফতি সৈয়দ মুহাম্মদ ফয়জুল করীমকে মেয়র প্রার্থী ঘোষণা করা হয়। এছাড়া গাজীপুরে দলের সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা গাজী আতাউর রহমান, খুলনায় দলের নায়েবে আমির হাফেজ মাওলানা আবদুল আউয়াল, সিলেটে দলের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক হাফেজ মাওলানা মাহমুদুল হাসান ও রাজশাহীতে রাজশাহী মহানগর সহসভাপতি হাফেজ মাওলানা মুরশিদ আলম ফারুকীকে মনোনয়ন দিয়েছে ইসলামী আন্দোলন।
দলটির কয়েকজন নেতার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বিএনপি নির্বাচন বর্জন করায় তারা সেই সুযোগটি নিতে চান। সুষ্ঠু ভোট হলে বিএনপির অনেক ভোট তাদের বাক্সে আসবে বলে মনে করছেন তারা। আবার ভোটে সরকারি দল প্রভাব খাটালে তারা এর দ্বারা প্রমাণ করতে চান- দলীয় সরকারের অধীনে কোনো সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়। তাছাড়া এই নির্বাচনের মাধ্যমে তারা জাতীয়ভাবে আরও আলোচনায় আসতে চান।
এই নির্বাচনে অংশ নেওয়ার কারণ ব্যাখ্যা করে দলের যুগ্ম মহাসচিব এবং গাজীপুর সিটির মেয়র প্রার্থী গাজী আতাউর রহমান বলেন, বাংলাদেশের নির্বাচনব্যবস্থার প্রতি গণমানুষের অনাস্থা তৈরি হয়েছে। আজকে নির্বাচন কমিশন বলছে তারা পরীক্ষায় অবতীর্ণ হতে চায়। আমরা নির্বাচন কমিশনের পরীক্ষা নেওয়ার জন্য নির্বাচনে এসেছি। আমরা নির্বাচন করছি মানুষের ভোটাধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনের অংশ হিসেবে।
ইসলামী আন্দোলনের এই নেতা বলেন, আমরা মনে করছি বিনা চ্যালেঞ্জে কোনো নির্বাচন ছেড়ে দেওয়াটা আমাদের জন্য বোকামি হবে। আমরা মনে করছি নির্বাচন কমিশন যেহেতু সুষ্ঠু, বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন করতে চায়, আমরা দেখতে চাই সিটি নির্বাচন তারা কেমন করে। পাঁচ সিটিতেই আমরা বিজয়ের জন্য নির্বাচন করব।
পাঁচ সিটির মধ্যে ইসলামী আন্দোলন সবচেয়ে বেশি জোর দিচ্ছে বরিশাল সিটিতে। কারণ বরিশাল সদরের চরমোনাইয়েই দলটির উৎপত্তি। সে হিসেবে বরিশালে তাদের একটি রিজার্ভ ভোট ব্যাংক রয়েছে। তাছাড়া বিএনপি নির্বাচনে অংশ না নেওয়ায় সেই সুবিধাটিও তারা নিতে চান। এজন্য দলের ‘সেকেন্ড ম্যান’ হিসেবে পরিচিত সিনিয়র নায়েবে আমির মুফতী সৈয়দ ফয়জুল করীমকে প্রার্থী করা হয়েছে। তিনি আওয়ামী লীগ প্রার্থী খোকন সেরনিয়াবাতের সঙ্গে মূল প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন বলে ধারণা করা হচ্ছে।
বরিশাল ছাড়া বাকি চার সিটিতেও হাতপাখা প্রতীকের ভালো ভোট রয়েছে। গত কয়েক বছরে ধারাবাহিকভাবে তাদের ভোটের পরিমাণ সারাদেশেই বাড়ছে। এ হিসেবে দলটির ধারণা, চার সিটিতেই তারা একটি ভালো অবস্থানে থাকতে পারবে।
২০১৮ সালে গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনের ফলাফলে দলটির অবস্থান ছিল তৃতীয়। মেয়র প্রার্থী মো. নাসিরউদ্দিন হাতপাখা প্রতীকে পান ২৬ হাজার ৩৮১ ভোট। সে বারই প্রথম তারা এই সিটিতে নির্বাচনে অংশ নেয়। খুলনা সিটির নির্বাচনেও প্রথমবার অংশ নিয়ে ইসলামী আন্দোলন পায় ১৪ হাজার ৩৬৩ ভোট। এটি ছিল ওই নির্বাচনে তৃতীয় সর্বোচ্চ ভোট।
এছাড়া ঢাকার দুই সিটি, রংপুর ও নারায়ণগঞ্জ সিটি নির্বাচনে একাধিকবার তৃতীয় অবস্থানে ছিলেন ইসলামী আন্দোলনের প্রার্থীরা। প্রতিটি নির্বাচনেই তাদের ভোটের সংখ্যা আনুপাতিক হারে বাড়ছে। এতে দলটি সামনে আরও ভালো করার ব্যাপারে আশাবাদী হয়ে ওঠেছে। সম্প্রতি স্থানীয় সরকার নির্বাচনে অংশ নিয়ে বেশ কয়েকটি ইউনিয়ন পরিষদেও জয় পেয়েছে চরমোনাই পীরের নেতৃত্বাধীন ইসলামি দলটি।
ইসলামি দলগুলোর মধ্যে এখন জনশক্তির দিক থেকে অনেকটা এগিয়ে রয়েছে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ। গত একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দলটি দেশের ৩০০ আসনে একক প্রার্থী দিয়ে তাদের শক্তির জানান দেয়। বেশির ভাগ প্রার্থী জামানত হারালেও এটাকে তারা বড় অর্জন হিসেবে দেখছে। কারণ ওই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ-বিএনপিসহ কোনো দলই সব আসনে নিজেদের প্রার্থী দিতে পারেনি।
১৯৮৭ সালে চরমোনাই পীর মাওলানা সৈয়দ মুহাম্মাদ ফজলুল করীম দলটি প্রতিষ্ঠা করেন। বর্তমানে এর আমির মুফতি সৈয়দ রেজাউল করীম। ১৯৯১ ও ১৯৯৬ সালে তারা সাত দল মিলে ইসলামী ঐক্যজোটের অধীনে নির্বাচন করে। ২০০১–এর নির্বাচনে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ জোট বাঁধে এরশাদের সঙ্গে। পরবর্তী সময়ে ২০০৮ সালের নির্বাচনে জোট থেকে বের হয়ে এককভাবে নির্বাচনে অংশ নেয়। সেবার ১৬০ আসনে প্রার্থী দিয়ে তারা আওয়ামী লীগ ও বিএনপি জোটের বাইরে একমাত্র দল হিসেবে মোট ভোটের ১ শতাংশের বেশি ভোট পায়।
২০১৪ সালের নির্বাচনে দলটি অংশ নেয়নি। ২০১৮ সালের নির্বাচনে ৩০০ আসনেই প্রার্থী দেয়। আগামী নির্বাচনে দলটির অবস্থান কী হবে তা এখনও পরিষ্কার নয়। বিএনপিসহ বিরোধী দলগুলোর নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবির সঙ্গে ইসলামী আন্দোলনও একমত পোষণ করেছে। তবে তারা বিএনপির সঙ্গে জোট বা যুগপৎ কোনো আন্দোলনে শুরু থেকেই নেই।
আওয়ামী লীগের সঙ্গে তাদের একটি সখ্য আছে বলে কোনো কোনো মহলের অভিযোগ রয়েছে। তবে দলটি শুরু থেকেই তা প্রত্যাখ্যান করে আসছে। তারা বলছে, আওয়ামী লীগের সঙ্গে সখ্য থাকলে ২০১৪ সালের নির্বাচনে অংশ নিত ইসলামী আন্দোলন। তারা নিজেদের আদর্শ, লক্ষ্য ও কর্মসূচি সামনে নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে বলে দাবি দলটির।