এস এম আল-ফাহাদ:
বাতাসে ধানের শব্দ শুনিয়াছি_ ঝরিতেছে ধীরে ধীরে অপরাহ্ন ভ’রে।’ রূপসী বাংলার কবি জীবনানন্দ দাশও বাতাসে ধানের শব্দ শুনেছেন। দেখেছেন রোদের সোনালি রঙ। জীবনানন্দ দাশের সেই ধান এবার বিস্তীর্ণ হাওরে রোদের সঙ্গে মিলেমিশে একাকার। যতদূর দৃষ্টি যায় শুধুই সোনালি ধান। আদিগন্ত হাওরের বুকে যেন সোনালি ধানের ঢেউ।
হাওরে গিয়ে দেখা গেছে, সোনালি ধানে ভরে গেছে ক্ষেতের পর ক্ষেত। হাওরের মৃদুমন্দ বাতাসে দুলছে লম্বা লম্বা পাকা ধানের সোনালি শীষ। দিগন্ত বিস্তৃত হাওরে শুরু হয়েছে ফসল কাটার মহোৎসব।
বিস্তীর্ণ হাওরের যেদিকে চোখ যায় শুধু সোনালি ধান আর ধান। এবার পতিত ছিল না কোনো জমি। মনে হবে এ যেন ধানের সমুদ্র!
কিশোরগঞ্জসহ সিলেট, সুনামগঞ্জ, হবিগঞ্জ, মৌলভীবাজার, নেত্রকোনা ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া_ এই সাত জেলার হাওর-অধ্যুষিত জনপদসহ সারাদেশেই চলছে এখন ধান কাটার উৎসব।
হাওড় অঞ্চলের কৃষকদের প্রধান ফসল বোরো ধান কেটে দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন সুনামগঞ্জ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মোঃ আবু নঈম শেখ। হাওড় অঞ্চলের ধান ভারতের চেরাপুঞ্জিতে পাহাড়ি ঢলে আগাম বন্যায় তলিয়ে যাবার শঙ্কায় তিনি স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীসহ অন্যান্যদের প্রতি এ আহ্বান জানান।
উপাচার্য আবহাওয়া বিভাগের বরাত দিয়ে বলেন- আগামী ২৩ এপ্রিল থেকে ৩ মে পর্যন্ত ভারতের মেঘালয় রাজ্যের চেরাপুঞ্জিতে টানা ১১ দিন ভারী বৃষ্টিপাত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এ সময় কালবৈশাখী ঝড় ও শিলাবৃষ্টিসহ ভারী বৃষ্টিপাতে হাওরাঞ্চলে আগাম বন্যা হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। তাই দ্রুত হাওরের পাকা ধান কেটে ফেলতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
তিনি বলেন -সুনামগঞ্জ সদর, দক্ষিণ সুনামগঞ্জ, দোয়ারাবাজার ও ছাতক চার উপজেলা নিয়ে সুনামগঞ্জের অন্যতম বৃহত্তম হাওর ‘দেখার হাওর’। দেখার হাওরকে বলা হয় বোরো ভান্ডার। গতকাল সুনামগঞ্জের শান্তিগঞ্জ উপজেলার দেখার হাওরে চাষীদের কাছে ছুটে গেলেন দেশের গুরুত্বপূর্ণ তিন মন্ত্রী।
কৃষিমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাক, পরিকল্পনা মন্ত্রী এমএ মান্নান, পানিসম্পদ উপমন্ত্রী একেএম এনামুল হক শামীম সামিল হলেন বোরো ধান কাটার উৎসবে, মতবিনিময় করলেন কৃষকদের সঙ্গে।
সুবিপ্রবি উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. আবু নঈম শেখ বলেন, চলমান ২০২২-২৩ অর্থবছরে সারা দেশে প্রায় ৫০ লাখ হেক্টর জমিতে বোরো ধান আবাদ হয়েছে। কোন প্রাকৃতিক দুর্যোগ না হলে ও সময়মতো ধান ঘরে তুলতে পারলে বোরোতে রেকর্ড উৎপাদন হবে। হাওরে বোরো ধান কাটা চলছে, এখন পর্যন্ত প্রায় ৩৫ ভাগ ধানকাটা হয়ে গেছে। এই মুহূর্তে শুধু সুনামগঞ্জেই ১ হাজার কম্বাইন হারভেস্টারে ধান কাটা চলছে। আশা করি, ৩০ তারিখের মধ্যেই হাওরের ধানকাটা হয়ে যাবে, এবার ধান কাটায় কোন সমস্যা হবে না।
হাওরে ধানকে ঝুঁকিমুক্ত, শঙ্কামুক্ত করতে সরকারের নানান পদক্ষেপ তুলে ধরে উপাচার্য বলেন, আগাম বন্যা ও পাহাড়ি ঢলের কারণে হাওরের ধান ঘরে তোলা নিয়ে প্রতি বছর আমাদের আতঙ্কে থাকতে হয়। পাকা ধান দ্রুত কাটার জন্য সরকার ৭০ শতাংশ ভর্তুকিতে হাওরে কম্বাইন হারভেস্টার দিচ্ছে। এর সুফল আমরা পাচ্ছি। গত কয়েক বছর ধরে দ্রুততার সাথে ধানকাটা যাচ্ছে। ফলে হাওরের ধান নিয়ে শঙ্কা অনেকটা কমে এসেছে।
উপাচার্য বলেন, এছাড়া স্বল্পজীবনকালীন ও ঠান্ডাসহিষ্ণু আগাম জাতের ধান চাষে গুরুত্ব দিতে হবে। যাতে ১৫ দিন আগেই ধান পাকে। এরই মধ্যে বিজ্ঞানীরা অনেকগুলো জাত উদ্ভাবন করেছেন। এ জাতগুলো দ্রুত সম্প্রসারণ করতে পারলে হাওরের ধান ঘরে তোলা নিয়ে কোনো শঙ্কা থাকবে না। পানি আসার আগেই ঘরে ধান তোলা যাবে।
ব্রি ২৮ ও ব্রি ২৯ জাতের ধান চাষ না করার জন্য কৃষকদের আহ্বান জানান উপাচার্য। তিনি বলেন, ব্রি ২৮ জাতটি পুরোনা হয়ে গেছে, সহজেই ব্লাস্টসহ নানান রোগে আক্রান্ত হচ্ছে, উৎপাদনশীলতাও কমে গেছে। ব্রি ২৯ একটু দেরিতে পাকে। এসব জাতের পরিবর্তে উচ্চ উৎপাদনশীল নতুন জাত যেমন ব্রি- ৮১, ব্রি- ৮৯, ব্রি- ৯২ চাষ করতে হবে। এদের ফলন প্রতি শতকে এক মণেরও বেশি।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের হিসাবে এবছর ৫০ লাখ হেক্টর জমিতে বোরো আবাদ হয়েছে, আর উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ২ কোটি ১৫ লাখ মেট্রিক টন চাল। গত ২০২১-২২ অর্থবছরে বোরো ধান আবাদ হয়েছিল ৪৮ লাখ ১৪ হাজার হেক্টর জমিতে, উৎপাদন হয়েছিল প্রায় ২ কোটি ২ লাখ টন চাল।
এদিকে হাওরভুক্ত সাতটি জেলা সিলেট, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, সুনামগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ, নেত্রকোনা ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ার হাওরে বোরো ধান কাটা শুরু হয়েছে। এখন পর্যন্ত হাওরের ৩৫ শতাংশ ধান কাটা হয়েছে। হাওরে এবছর বোরো আবাদ হয়েছে ৪ লাখ ৫২ হাজার হেক্টর জমিতে। আর এই সাতটি জেলায় মোট বোরো আবাদ হয়েছে (হাওর ও উঁচু জমি মিলে) ৯ লাখ ৫৩ হাজার হেক্টর জমিতে, উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ৪০ লাখ টন চাল।