ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া ভাঙচুর, পুলিশের লাঠিচার্জে আহত সাংবাদিকরাও
ভোট গ্রহণে শুরুতে বিলম্ব, উত্তেজনা : তফসিল অনুযায়ী সুপ্রিম কোর্ট বারের ২০২৩-২০২৪ মেয়াদের কার্যনির্বাহী কমিটির নির্বাচনের দুই দিনব্যাপী ভোট গ্রহণের জন্য গতকাল বুধবার ও আজ বৃহস্পতিবার ধার্য রয়েছে। দুই দিনই সকাল ১০টা থেকে শুরু হয়ে বিরতিহীনভাবে বিকাল ৫টা পর্যন্ত ভোট গ্রহণের কথা। তবে গতকাল সকাল ১০টায় ভোট গ্রহণের নির্ধারিত সময়ে বিএনপি সমর্থিত সভাপতি প্রার্থী ব্যারিস্টার এম মাহাবুব উদ্দিন খোকন, সম্পাদক প্রার্থী ব্যারিস্টার রুহুল কুদ্দুস কাজলসহ বিএনপি-জামায়াতপন্থি আইনজীবীরা বুথ দখলে নেন। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, এ সময় তারা বলতে থাকেন, নতুন নির্বাচন পরিচালনা কমিটি গঠন ছাড়া ভোট গ্রহণ হবে না। প্রায় সাড়ে ১১টা পর্যন্ত ভোট কেন্দ্রেই বিক্ষোভ করতে থাকেন বিএনপিপন্থি আইনজীবীরা। এরপর আওয়ামী লীগ সমর্থক প্রার্থীরাও ভোট কেন্দ্রে প্রবেশ করলে হট্টগোল শুরু হয়। এ সময় শতাধিক পুলিশ সদস্য ভোট কেন্দ্রে প্রবেশ করে লাঠিচার্জ ও মারপিট শুরু করেন। এ সময়ে ভোট কেন্দ্রের বাইরে কয়েকবার দুই পক্ষের আইনজীবীদের মধ্যে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার ঘটনা ঘরে। পরে বেলা পৌনে ১২টার দিকে ভোট গ্রহণ শুরু হয়ে চলে বিকাল ৫টা পর্যন্ত।
সাংবাদিকদের ওপর পুলিশের হামলা, নিন্দা–প্রতিবাদ : বেলা সাড়ে ১১টায় ভোট কেন্দ্রে দুই পক্ষের আইনজীবীদের হট্টগোল শুরু হলে সুপ্রিম কোর্ট এলাকায় কর্মরত সাংবাদিকরা সংবাদ সংগ্রহের জন্য ঘটনাস্থলে যান। এ সময় সাংবাদিকদেরও এলোপাতাড়ি মারধর শুরু করে পুলিশ। প্রত্যক্ষদর্শী কয়েকজন সাংবাদিক জানান, সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতি নির্বাচনে ভোট কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহৃত অডিটরিয়ামে নতুন নির্বাচন কমিশন গঠনের দাবিতে বিক্ষোভ করছিলেন বিএনপিপন্থি আইনজীবীরা। তাদের অডিটরিয়াম থেকে বের করে দেওয়ার জন্য সেখানে প্রবেশ করেন বিপুলসংখ্যক পুলিশ সদস্য। তারা সেখানে ঢুকেই বিএনপিপন্থি আইনজীবীদের ওপর লাঠিচার্জ করেন। এ ঘটনার ছবি ও ভিডিও ফুটেজ নিচ্ছিলেন সাংবাদিকরা। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে অতর্কিতভাবে সাংবাদিকদের মারধর ও লাঠিচার্জ শুরু করে পুলিশ। গলায় নিজ নিজ প্রতিষ্ঠানের আইডি কার্ড এবং টেলিভিশন সাংবাদিকদের হাতে মাইক্রোফোন থাকার পরও গণমাধ্যমকর্মীদের মারধর করে পুলিশ। সাংবাদিকদের অকথ্য ভাষায় গালিগালাজও করেন পুলিশ সদস্যরা।ঘটনার পরপরই সুপ্রিম কোর্ট এলাকায় কর্মরত সাংবাদিকদের সংগঠন ল’ রিপোর্টার্স ফোরামের সভাপতি আশুতোষ সরকার ও সাধারণ সম্পাদক আহাম্মেদ সরোয়ার হোসেন ভূঞার নেতৃত্বে সিনিয়র সাংবাদিকরা বিষয়টি প্রধান বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকীকে অবহিত করেন। প্রধান বিচারপতি এ ঘটনায় মর্মাহত হয়েছেন বলে জানান। একই সঙ্গে দায়ী পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের আশ্বাস দেন।
পুলিশের হামলায় ল’ রিপোর্টার্স ফোরামের যুগ্ম সম্পাদক জাগো নিউজের সিনিয়র রিপোর্টার ফজলুল হক মৃধা, সংগঠনের দফতর সম্পাদক আজকের পত্রিকার স্টাফ রিপোর্টার এস এম নূর মোহাম্মদ, এটিএন নিউজের সিনিয়র রিপোর্টার জাবেদ আখতার, ইন্ডিপেন্ডেন্ট টিভির সিনিয়র রিপোর্টার জান্নাতুল ফেরদাউস তানভী, বৈশাখী টিভির ক্যামেরাপারসন ইব্রাহীমসহ ১০ থেকে ১২ জন গণমাধ্যমকর্মী আহত হন। এদের মধ্যে এটিএন নিউজের জাবেদ আখতার গুরুতর আহত হওয়ায় তাকে হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে। এ হামলার ঘটনায় আরও নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়েছে বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়ন, ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়ন, ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি, রিপোর্টার্স অ্যাগেইনস্ট করাপশন, ব্রডকাস্ট জার্নালিস্ট সেন্টার।
ব্রিফিং শেষে ধাওয়া করে ভাঙচুর : বেলা ৩টা ১০ মিনিটে সুপ্রিম কোর্টের এনেক্স ভবনের সামনে দিনের ঘটনা বর্ণনা করে সংবাদ সম্মেলন করেন বিএনপি সমর্থক প্রার্থীরা। এর পরপরই তারা নির্বাচন পরিচালনা কমিটির স্থাপন করা নির্বাচনী প্যান্ডেল ভাঙচুর করেন। এ প্যান্ডেল থেকে আগত ভোটারদের ভোটার স্লিপ প্রদান করা হচ্ছিল। এ সময় প্রায় আধঘণ্টা ধরে সংঘর্ষ ও ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার ঘটনা ঘটে।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, বেলা সাড়ে ৩টার দিকে সাংবাদিকদের ব্রিফিং শেষ করেই বিএনপির সভাপতি প্রার্থী মাহাবুব উদ্দিন খোকনের নেতৃত্বে বিএনপি-জামায়াত সমর্থক আইনজীবীরা মিছিল নিয়ে ধাওয়া করে আসেন নির্বাচনী প্যান্ডেলের দিকে। পরে প্যান্ডেলের ভিতরে থাকা চেয়ার, টেবিল, ফ্যান ভাঙচুর করেন তারা। এ সময় সমিতি ভবনের নিচতলায় ১৪৬ নম্বর রুমের দরজা, সমিতির লাইব্রেরির দরজা এবং দরজার সামনে রাখা চেয়ার ও পানির ফিল্টার ভাঙচুর করা হয়। পরে পুলিশ পাল্টা ধাওয়া দিলে তারা সরে যান। এ সময় প্রায় বিকাল ৪টা পর্যন্ত ভোট গ্রহণ বন্ধ থাকে। পরে ৪টায় শুরু হয়ে বিকাল ৫টায় শেষ হয় প্রথম দিনের ভোট।
বিএনপিপন্থিদের দায়ী করলেন সুপ্রিম কোর্ট বার সভাপতি : সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সৃষ্ট পরিস্থিতির জন্য বিএনপি সমর্থক আইনজীবীদের দায়ী করেছেন সমিতির বর্তমান সভাপতি ও আওয়ামী লীগ সমর্থিত সাদা প্যানেলের সভাপতি প্রার্থী অ্যাডভোকেট মোমতাজ উদ্দিন ফকির। তিনি বলেন, ভোটে পরাজয় নিশ্চিত জেনে বিএনপি সমর্থিত প্রার্থীরা ভোট বানচালের চেষ্টা চালান। বিএনপি প্যানেলের সভাপতিপ্রার্থী মাহাবুব উদ্দিন খোকন ও সম্পাদকপ্রার্থী রুহুল কুদ্দুস কাজলের নেতৃত্বে মঙ্গলবার রাতে ব্যালট পেপার ছিনতাই করা হয়। এ ঘটনায় মামলা করা হয়েছে। তিনি বলেন, আজ (গতকাল) সকাল থেকেই বিএনপির প্রার্থীরা ভোট বন্ধ করতে বারবার চেষ্টা করেছেন। তারা ভোট কেন্দ্রের ভিতরেও গণ্ডগোল সৃষ্টি করেছেন। নির্বাচনী প্যান্ডেল ভাঙচুর করেছেন। এসব ঘটনায়ও মামলা দায়েরের প্রস্তুতি চলছে।
সাংবাদিকদের ওপর পুলিশের হামলার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘বিষয়টি আমার জানা নেই। তবে এ ধরনের ঘটনা কখনোই সমর্থনযোগ্য নয়। দায়ীদের বিচার হতে হবে।’
গ্রহণযোগ্য কমিটির অধীনে নির্বাচন দাবি বিএনপিপন্থিদের : সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতি নির্বাচন পরিচালনার জন্য সবার মতামতের ভিত্তিতে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন পরিচালনা কমিটি গঠন করে নতুন করে ভোট গ্রহণের দাবি জানিয়েছেন বিএনপি সমর্থিত আইনজীবীরা। গতকাল বিকাল সোয়া ৩টার দিকে সুপ্রিম কোর্টের অ্যানেক্স ভবনের সামনে তাৎক্ষণিক সংবাদ সম্মেলনে এ দাবি করেন নীল প্যানেলের সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক প্রার্থী মাহাবুব উদ্দিন খোকন ও রুহুল কুদ্দুস কাজল।
সংবাদ সম্মেলনে মাহবুব উদ্দিন খোকন বলেন, ‘সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতি নির্বাচনে ভোট চুরিতে পুলিশ জড়িত। তারা আমাদের মেরে ভোট কেন্দ্র থেকে বের করে দিয়েছে। এখন সাধারণ আইনজীবীদের ডেকে সবার মতামত নিয়ে নতুন করে ভোট গ্রহণ করতে হবে। তা না হলে আমাদের আন্দোলন চলবে।’ এ সময় সম্পাদক প্রার্থী রুহুল কুদ্দুস কাজল বলেন, ‘সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির বিভিন্ন সিদ্ধান্ত হয় সংখ্যাগরিষ্ঠের মতামতের ভিত্তিতে। নির্বাচন পরিচালনার জন্য যে সাব-কমিটি হয়, সেটি হয় সর্বসম্মতিক্রমে। সেই মোতাবেক সিনিয়র আইনজীবী মুনসুরুল হক চৌধুরীকে প্রধান করে একটি সর্বজনবিদিত কমিটি হয়। সেই কমিটির প্রধান মুনসুরুল হককে অপমান করে পদত্যাগে বাধ্য করা হয়েছে। এখন নিজেদের মতো একটি কমিশন করে ভোট চুরির পাঁয়তারা করা হচ্ছে। তাদের ভোট চুরিতে বাধা দেওয়ায় পুলিশ দিয়ে আমাদের নির্যাতন করে ভোট কেন্দ্র থেকে বের করে দেওয়া হয়েছে। এ অবস্থায় সবার মতামতের ভিত্তিতে নির্বাচন সাব-কমিটি গঠন করে নতুন করে নির্বাচন দিতে হবে।’