তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, দেশে সাধারণত মার্চ থেকে জুন পর্যন্ত বিদ্যুতের চাহিদা বাড়ে। এবার এই সময়ে বিদ্যুতের চাহিদা বেড়ে দাঁড়াবে ১৬ হাজার মেগাওয়াটের বেশি। বর্তমানে দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা ২৪ হাজার ১১৪ মেগাওয়াট। এখন সর্বোচ্চ বিদ্যুৎ উৎপাদিত হচ্ছে ১১ হাজার মেগাওয়াট। উৎপাদন সক্ষমতা উদ্বৃত্ত থাকা সত্ত্বেও বিদ্যুৎকেন্দ্রের জ্বলানিসংকটের কারণে সক্ষমতার কতটা উৎপাদন করা যাবে, তা নিয়ে সংশয় আছে।

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, পরিস্থিতি সামাল দিতে সরকার বেশ কিছু আগাম পদক্ষেপ নিয়েছে। সরকারের এসব পদক্ষেপের মধ্যে বিদ্যুৎকেন্দ্রে গ্যাস সরবরাহ বাড়াতে স্পট মার্কেট থেকে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) আমদানি শুরু করেছে। কয়লা ও জ্বালানি তেলের মজুদ বাড়ানোর উদ্যোগও নেওয়া হয়েছে। এবার সরকারের বড় ভরসা কয়লাভিত্তিক বৃহৎ তিন বিদ্যুৎকেন্দ্র রামপাল, পায়রা ও ভারতের আদানির বিদ্যুৎ। তবে রামপাল ও পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্রে কয়লার সরবরাহ নিরবচ্ছিন্ন রাখা যাবে কি না, তা নিয়ে এখনো শঙ্কা আছে।
বিদ্যুৎ বিভাগের নীতি ও গবেষণা শাখা পাওয়ার সেলের মহাপরিচালক (ডিজি) মোহাম্মদ হোসাইন গতকাল রবিবার কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘এবার বিদ্যুৎসংকট মোকাবেলায় সব ধরনের প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে। আশা করছি, জ্বালানিসংকটে বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যাহত হবে না। তবে নিশ্চিতভাবে বলা যায়, গতবছরের মতো লোড শেডিং থাকবে না।’
পাওয়ার সেল সূত্র জানায়, ২৪ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতার মধ্যে গ্যাসচালিত ৪৮ শতাংশ, ফার্নেস অয়েলচালিত ২৫ শতাংশ, কয়লাভিত্তিক ১২ শতাংশ এবং ডিজেলচালিত সাড়ে ৫ শতাংশ।
বিপিডিবি পেট্রোবাংলার কাছে দৈনিক এক হাজার ২০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাসের চাহিদা দিয়েছে। সম্প্রতি অর্থ বিভাগের কাছে পেট্রোবাংলা একটি চিঠি দিয়েছে। এতে বলা হয়েছে, স্পট মার্কেট ও দীর্ঘমেয়াদি চুক্তির মাধ্যমে তরল প্রাকৃতিক গ্যাসের চাহিদা মেটাতে তাদের পাঁচ মাসে প্রায় ১.৭৫ বিলিয়ন ডলার প্রয়োজন হবে।
পেট্রোবাংলা সূত্র বলছে, আগামী জুনের মধ্যে স্পট মার্কেট থেকে ১০ থেকে ১২ কার্গো এলএনজি আমদানির পরিকল্পনা করছে। কাতার ও ওমানের সঙ্গে দীর্ঘমেয়াদি চুক্তির অধীনে আরো ২৪ কার্গো এলএনজি আসার কথা আছে।
কয়লার জোগান অব্যাহত থাকা নিয়ে সংশয়ে রামপাল ও পায়রা : কয়লাসংকটে এক মাস বন্ধ থাকার পর ১৪ ফেব্রুয়ারি আবার উৎপাদন শুরু করেছে বাংলাদেশ-ভারতের যৌথ বিনিয়োগে নির্মিত রামপাল তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্রের একটি ইউনিট। গ্রীষ্মে এখান থেকে প্রায় ৬০০ মেগাওয়াট পর্যন্ত বিদ্যুৎ পাওয়া যেতে পারে। কিন্তু ঋণপত্র (এলসি) খোলার জটিলতা স্বাভাবিক না হলে কয়লাসংকটে এপ্রিলের পর ফের কেন্দ্রটির উৎপাদন বন্ধ হয়ে যাওয়ার শঙ্কা আছে।
আগামী জুন থেকে উৎপাদনে যাওয়ার কথা ছিল বিদ্যুৎকেন্দ্রটির দ্বিতীয় ইউনিটের। কিন্তু কয়লাসংকটে আগস্টের আগে উৎপাদনে যাওয়ার সম্ভাবনা নেই বলে জানিয়েছেন বিদ্যুৎকেন্দ্রটির প্রকল্প পরিচালক সুভাষ চন্দ্র পাণ্ডে। তিনি বলেন, বর্তমানে যে কয়লা মজুদ রয়েছে এবং পাইপলাইনে আছে, তা দিয়ে কেন্দ্রটির একটি ইউনিট আগামী এপ্রিল পর্যন্ত চালানো সম্ভব হবে। এলসি জটিলতা না কাটলে কয়লা আমদানি ব্যাহত হবে, ফলে এপ্রিলের পর কেন্দ্রটি চালু রাখা সম্ভব হবে না।
কয়লাসংকটে বিদ্যুৎ উৎপাদন বন্ধের শঙ্কায় পটুয়াখালীতে অবস্থিত পায়রা তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্রও। কয়লার সরবরাহ স্বাভাবিক থাকলে গ্রীষ্মে এই বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে এক হাজার ২০০ মেগাওয়াট পর্যন্ত বিদ্যুৎ পাওয়া যাবে। কিন্তু ডলার সংকটে বকেয়া বিল পরিশোধ করতে না পারায় কয়লা আমদানি করতে পারছে না পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্র কর্তৃপক্ষ। বর্তমানে কেন্দ্রটির যে মজুদ আছে, সেটি দিয়ে আর মাত্র ২০ দিনের মতো উৎপাদন করা যাবে বলে এর দায়িত্বরত এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন।
গরমে বাড়ছে লোড শেডিং : রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় এখন এক ঘণ্টা লোডশেডিং হলেও ঢাকার বাইরের জেলা শহর ও গ্রামাঞ্চলে চার থেকে ছয় ঘণ্টা করে লোড শেডিংয়ের অভিযোগ পাওয়া গেছে। এখনই বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য জ্বালানির সরবরাহ নিশ্চিত করা না গেলে গ্রীষ্ম মৌসুমে সর্বোচ্চ চাহিদার সময় লোড শেডিং আরো বাড়বে।
গ্রাহকরা বলছেন, সাধারণত শীত মৌসুমে বিদ্যুতের চাহিদা তুলনামূলক অনেক কম থাকে। তবে এবার শীতেও রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশেই লোড শেডিং হয়। শীত কমার সঙ্গে সঙ্গে বাড়ছে লোড শেডিংয়ের মাত্রা।
দেশের সবচেয়ে বড় বিতরণ কম্পানি বাংলাদেশ পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডের (আরইবি) দায়িত্বরত কর্মকর্তারা লোড শেডিংয়ের বিষয়টি স্বীকার করেছেন। আরইবির এক পরিচালক গতকাল কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘চাহিদা অনুযায়ী আমরা বিদ্যুৎ কম পাচ্ছি, যার কারণে আমাদের বিতরণ এলাকায় লোড শেডিং করতে হচ্ছে। গ্রীষ্মে লোড শেডিং বাড়তে পারে এবার।’
বিদ্যুৎ বিভাগ সূত্র বলছে, গত বছরের জুলাই মাস থেকে বিদ্যুত্সংকট মোকাবেলায় দেশজুড়ে এলাকাভিত্তিক লোড শেডিংয়ের সিদ্ধান্ত নিয়েছিল সরকার। জুলাই থেকে অক্টোবর পর্যন্ত দিনে সর্বোচ্চ তিন হাজার মেগাওয়াট পর্যন্ত শোড শেডিং করা হয়। তখন রাজধানীতেই চার ঘণ্টা পর্যন্ত লোডশেডিং ছিল। আর ঢাকার বাইরের জেলা শহর ও গ্রামাঞ্চলে ১০ থেকে ১৪ ঘণ্টা পর্যন্তও লোড শেডিং ছিল।