রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধ বাংলাদেশের অর্থনীতিতে প্রভাব
রাশিয়া ২০২২ সালের ২৪শে ফেব্রুয়ারি ইউক্রেন আক্রমণ করে। এই আক্রমণটিকে আন্তর্জাতিকভাবে আগ্রাসন হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এটি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে ইউরোপের সবচেয়ে বড় শরণার্থী সংকটের সূত্রপাত করে। ৮.৮ মিলিয়নেরও বেশি ইউক্রেনীয় দেশ ছেড়েছে এবং আরও লক্ষাধিক অভ্যন্তরীণভাবে বাস্তুচ্যুত হয়।
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বিশ্বজুড়ে জ্বালানী তেলের দাম হু হু করে বেড়েছে। বিশ্ববাজারে তেল-গ্যাস সরবরাহের ক্ষেত্রে রাশিয়া বেশ গুরুত্বপূর্ণ। জ্বালানী তেলের আমদানি ব্যয় মেটাতে এখন হিমশিম খাচ্ছে বাংলাদেশ সরকার। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, আসছে বাজেটে জ্বালানী তেলের ভর্তুকির জন্য সরকারকে অনেক টাকা গুণতে হবে।
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে বাংলাদেশের বৈদেশিক বাণিজ্য ঘাটতি বেড়ে যাওয়া এবং ডলারের বিপরীতে টাকার দরপতন হতে পারে। এই যুদ্ধ দীর্ঘায়িত হলে বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম বাড়বে। এর প্রভাবে দেশে পরিবহনভাড়া ও কৃষি উৎপাদন খরচ বেড়ে যাবে। তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাসের (এলএনজি) দাম বাড়ারও আশঙ্কা আছে। রাশিয়ায় তৈরি পোশাক রপ্তানিও হুমকির মুখে পড়তে পারে।
বাংলাদেশে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের অর্থনৈতিক প্রভাব নিয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক প্রতিবেদনে এসব আশঙ্কার কথা বলা হয়েছে। গত বুধবার জাতীয় সংসদ ভবনে অনুষ্ঠিত পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির বৈঠকে এই প্রতিবেদন উপস্থাপন করা হয়।
বাংলাদেশ থেকে রাশিয়ায় ৬৫০ মিলিয়ন ডলারের তৈরি পোশাক রপ্তানি হয়। রাশিয়ার বেশ কয়েকটি ব্যাংককে বৈশ্বিক আন্তব্যাংক লেনদেনসংক্রান্ত সুইফট সিস্টেমে নিষিদ্ধ করার ফলে রাশিয়ায় তৈরি পোশাক রপ্তানি হুমকির মধ্যে পড়তে পারে। ফলে যেসব পোশাকের অর্ডার শিপমেন্টের জন্য প্রস্তুত রয়েছে, তার মূল্য পাওয়া নিয়ে শঙ্কা রয়েছে।
এই যুদ্ধের প্রভাব নিয়ে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, যুদ্ধ অব্যাহত থাকলে পণ্যবাহী জাহাজের ভাড়া ও বিমা মাশুল বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা আছে। বাংলাদেশ পণ্য রপ্তানির পুরোটাই এফওবি (ফ্রি অন বোর্ড) ভিত্তিতে করে থাকে। তাই পণ্য রপ্তানি ব্যয় বাড়বে না। তবে আমদানির বেশির ভাগই সিঅ্যান্ডএফ (কস্ট অ্যান্ড ফ্রেইট) ভিত্তিতে হয়। ফলে পণ্যবাহী জাহাজের ভাড়ার কারণে আমদানিকারকদের খরচ বেড়ে যাবে। এর প্রভাব পড়বে আমদানিকৃত পণ্যমূল্যে।
আমদানি ব্যয় বাড়বে, যা বাণিজ্য ঘাটতিও বাড়াবে। প্রতিবেদনে বলা হয়, চলতি অর্থবছরের প্রথমার্ধে বাণিজ্য ঘাটতি ১ হাজার ৫৬১ কোটি ডলারে গিয়ে দাঁড়িয়েছে। গত অর্থবছরের একই সময়ে এই ঘাটতির পরিমাণ ছিল ৬৮৭ কোটি ডলার। বৈদেশিক মুদ্রা বিনিময় হারের ওপর চাপ বেড়ে ডলারের বিপরীতে টাকার আরও দরপতন ঘটাতে পারে।
বাংলাদেশের মানুষ ক্যালরির জন্য ভাতের উপর নির্ভরশীল। তবে আটা- ময়দার উপরও ধীরে ধীরে নির্ভরশীলতা বাড়ছে। আর এই আটা-ময়দা আসে গম থেকে। ইন্টারন্যাশনাল ফুড পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট-এর গবেষণা প্রবন্ধে বলা হয়েছে, গত ২০ বছরে বাংলাদেশে গমের চাহিদা প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে।বাংলাদেশে তার চাহিদার ৮০ শতাংশ গম আমদানি করে। এর অর্ধেক আসে ইউক্রেন এবং রাশিয়া থেকে।কিন্তু সে সরবরাহ ব্যবস্থা বাধাগ্রস্ত হবার কারণে গমের দাম বেড়েছে। ফলে বাংলাদেশে আটা-ময়দার দামও বেড়েছে। সেই সাথে আটা-ময়দা দিয়ে তৈরি খাদ্যর দাম বেড়েছে বেশ খানিকটা।
বাংলাদেশে ভোজ্য তেলের দাম এখন লাগামছাড়া। যদিও বাংলাদেশের ভোজ্য তেলের বেশিরভাগই আসে পাম অয়েল এবং সয়াবিন অয়েল থেকে। বিশ্বজুড়ে যেসব ভোজ্য তেল ব্যবহার হয় তার মধ্যে সানফ্লাওয়ার   তেল প্রায় ১৩ শতাংশ। এর প্রায় ৭৫ শতাংশই আসে ইউক্রেন এবং রাশিয়া থেকে। যেহেতু এই সরবরাহ ব্যবস্থা  বিঘ্নিত হচ্ছে, সেজন্য বিশ্বজুড়ে ভেজিটেবল অয়েলের চেইনের দাম বৃদ্ধি পেয়েছে।
বিশ্ববাজারে সিংহভাগ সার রপ্তানির ক্ষেত্রে রাশিয়া এবং বেলারুশের ভূমিকা রয়েছে। রাশিয়ার উপর রপ্তানি নিষেধাজ্ঞা দেবার ফলে সেটি বাংলাদেশকেও প্রভাবিত করবে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশ রাশিয়া থেকে সার আমদানি করে। সেটি ব্যাহত হলে ভিন্ন কোন উৎস দেখতে হবে। এতে করে খরচ বাড়বে কৃষি খাতে।
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বিশ্বজুড়ে জ্বালানী তেলের দাম হু হু করে বেড়েছে। বিশ্ববাজারে তেল-গ্যাস সরবরাহের ক্ষেত্রে রাশিয়া বেশ গুরুত্বপূর্ণ। জ্বালানী তেলের আমদানি ব্যয় মেটাতে বিশ্ব এখন হিমশিম খাচ্ছে।
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাব মোকাবেলায় সরকারের গৃহীত পদক্ষেপঃ ঢাকা, ২৭ জুলাই, ২০২২ (বাসস): রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বিশ্বব্যাপী সৃষ্ট সংকটের প্রভাব মোকাবেলায় সরকার সতর্ক রয়েছে বলে জানিয়েছেন স্থানীয় সরকার পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রী মো. তাজুল ইসলাম।
তাজুল ইসলাম বলেন, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বিশ্বের প্রায় সকল দেশই কৃচ্ছ্রতা সাধন নীতি অনুসরণ করছে। জ্বালানি সংকট ও খাদ্য দ্রব্যের মূল্য বৃদ্ধিসহ আমদানি-রপ্তানির ওপর প্রভাব পড়ছে। আর এটা শুধু বাংলাদেশে নয় পুরো বিশ্বে সে প্রভাব পড়েছে। শুধু টাকার মান কমেছে এটি সঠিক নয়, ইউরো, ইয়েন ও রুপিসহ অনেক দেশের মুদ্রার মান কমেছে।
তিনি আরো জানান, কোন দেশেই পরিবর্তন একদিনে আসে না। চোখের পলকে দেশকে পরিবর্তন করা সম্ভব নয়। বিশ্বের কোনো দেশই তা পারেনি। সময়ের ব্যবধানে ধীরে ধীরে একটি দেশ উন্নয়নের লক্ষ্যে পৌঁছে।
তিনি আরো বলেন, ২০৪১ সালের মধ্যে দেশকে উন্নত-সমৃদ্ধ দেশে রূপান্তরিত করতে হলে যুব সমাজকে অর্থনৈতিক কর্মকান্ডে ব্যাপকভাবে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। যুবারা দেশের শক্তি। তারাই বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা বিনির্মাণে নেতৃত্ব দেবে। আগামীর উন্নত বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় স্বপ্নের সারথী হলো দেশের যুব সমাজ। তাদের অংশগ্রহণ দেশকে নির্দিষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছার পথকে সহজ করে দেবে। এজন্য সরকারের পাশাপাশি তাদের বেসরকারি খাতে এগিয়ে আসতে হবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ক্ষমতায় আসার পর বাংলাদেশকে কাঙ্খিত লক্ষ্যে নিয়ে যেতে যে পথনকশা তৈরি করেছেন, সে নকশা অনুযায়ী কাজ করে চলেছেন। দেশে অনেক উন্নয়ন হয়েছে, সাফল্যের অনেক গল্প আছে। এগুলো অস্বীকার করার কোনো সুযোগ নেই।
লেখকঃ পপি আক্তার, শিক্ষার্থী 
লোক প্রশাসন বিভাগ,  কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়। 

সর্বশেষ