কোভিড-১৯ সংকট মোকাবেলায় সরকারের বিভিন্ন কর্মসূচি বাস্তবায়নে স্থানীয় ক্ষমতাশীলদের নেতিবাচক প্রভাব ছিল : গবেষণা

কোভিড-১৯ সংকট মোকাবেলায় সরকারের বিভিন্ন কর্মসূচি বাস্তবায়নে স্থানীয় ক্ষমতাশীলদের নেতিবাচক প্রভাব ছিল : গবেষণা

 

ঢাকা ১৩ জানুয়ারি ২০২২ :

করোনা ভাইরাসের কারণে সৃষ্ট সংকট মোকাবেলায় সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি সংস্থাসমূহের কার্যকর অংশগ্রহণ এবং বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ ও বাস্তবায়নের চ্যালেঞ্জ থেকে উত্তরণের জন্য গবেষণার সার্বিক পর্যবেক্ষণে দেখা যায়, কোভিড-১৯ সংকট মোকাবেলায় সরকারের বিভিন্ন কর্মসূচি বাস্তবায়নে অংশীজন হিসেবে বেসরকারি সংস্থাসমূহের উল্লেখযোগ্য ভূমিকা ছিল।

বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের কোভিড-১৯ সংক্রান্ত তহবিল ও চলমান প্রকল্পের তহবিল ছাড়াও সাধারণ তহবিল হতে ত্রাণ ও খাদ্য সহায়তা, নগদ অর্থ বিতরণ, সচেতনতামূলক কার্যক্রম, স্বাস্থ্যসেবা ও সুরক্ষাসামগ্রী প্রদান, লাশ দাফন ও সৎকারসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে দ্রুততার সাথে সাড়া প্রদান করে।

সরকার ঘোষিত প্রণোদনা প্যাকেজ হতে প্রান্তিক ও নি¤œ আয়ের জনগোষ্ঠীর মধ্যে ঋণ বিতরণের ক্ষেত্রে ক্ষুদ্রঋণ সংস্থাগুলো তুলনামূলক বেশি কার্যকর ছিল।

নিয়মিত আয়ের উৎস না থাকা, দাতা সংস্থা কর্তৃক তহবিল হ্রাস এবং ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত হওয়ায় করোনা সংকট মোকাবেলায় কর্মসূচি বাস্তবায়নে সংস্থাগুলোর তহবিল সংকট ছিল মূল চ্যালেঞ্জ।

অন্যদিকে করোনা অতিমারীর সময়েও ত্রাণ বিতরণের ক্ষেত্রে উপকারভোগীর তালিকা প্রণয়নে স্থানীয় ক্ষমতাশীলদের নেতিবাচক প্রভাব ছিল।

‘করোনা সংকট মোকাবেলায় সাড়াদানকারী বেসরকারি সংস্থাসমূহের ভূমিকা: চ্যালেঞ্জ ও করণীয়’ শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ উপলক্ষে বৃহস্পতিবার আয়োজিত ভার্চুয়াল সংবাদ সম্মেলনে এ সকল তথ্য উঠে আসে।

টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান সভাপতিত্বে সম্মেলনে আব্দুল হান্নান সাখিদার গবেষণায় প্রাপ্ত তথ্য তুলে ধরেন।

কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া অধিকাংশ বেসরকারি সংস্থার করোনা কর্মসূচি সংক্রান্ত তহবিল সংগ্রহ ও ব্যয়ে তেমন কোনো অনিয়ম চিহ্নিত না হলেও স্বপ্রণোদিত তথ্য প্রকাশের ঘাটতি ছিল। করোনাকালীন বিভিন্ন মেয়াদে ক্ষুদ্র ঋণের কিস্তি আদায় বন্ধ রাখার নির্দেশনা থাকলেও বেশ কিছু সংস্থার বিরুদ্ধে কিস্তি আদায়ে চাপ প্রয়োগের অভিযোগ পাওয়া যায়।

করোনাকালীন প্রাথমিক পর্যায়ে সরকারি ও বেসরকারি সংস্থার সমন্বয়হীনতা দেখা গেলেও পরবর্তীতে স্বাস্থ্যসেবা, ত্রাণ বিতরণসহ বিভিন্ন কার্যক্রমে সমন্বয়ের উন্নয়ন ঘটলেও বেসরকারি সংস্থা ও তদারকি সংস্থার অভিযোগ নি®পত্তি ব্যবস্থায় ঘাটতি পরিলক্ষিত হয়।

গবেষণায়, করোনা ভাইরাসের কারণে সৃষ্ট সংকট মোকাবেলায় সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি সংস্থাসমূহের কার্যকর অংশগ্রহণ এবং বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ ও বাস্তবায়নের চ্যালেঞ্জ থেকে উত্তরণের জন্য ১০টি সুপারিশ প্রদান করা হয়েছে। সুপারিশসমূহ হল-

করোনাকালে তৃণমূল পর্যায়ে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থাসমূহের বিভিন্ন কার্যক্রমের (সচেতনতা বৃদ্ধি, খাদ্য সহায়তা, স্বাস্থ্যসেবা, নগদ অর্থ সহায়তা এবং ত্রাণ তৎপরতা) ধারাবাহিকতা রক্ষা এবং সমন্বয় সাধন করতে হবে।

বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা কর্তৃক করোনাকালীন গৃহীত কর্মসূচির ধরন, আওতা, ব্যয়, উপকারভোগীর তথ্য ইত্যাদি স্ব স্ব প্রতিষ্ঠানের ওয়েবসাইটে পরিপূর্ণভাবে প্রকাশ ও নিয়মিতভাবে হালনাগাদ করতে হবে।
করোনাকালীন মাঠ পর্যায়ে বেসরকারি সংস্থা কর্তৃক পরিচালিত কার্যক্রম বিশেষত উপকারভোগীদের ত্রাণ সংক্রান্ত অভিযোগ গ্রহণ ও নিষ্পত্তিতে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। এক্ষেত্রে তদারকি সংস্থা কর্তৃক মনিটরিং ব্যবস্থা জোরদার করতে হবে।

কার্যক্রম বাস্তবায়নে সমন্বয়হীনতা নিরসনে তদারকি সংস্থা কর্তৃক উপকারভোগীদের তথ্য সংবলিত একটি সমন্বিত ডাটাবেজ ও ডিজিটাল ম্যাপ তৈরি করতে হবে।

যেকোনো দুর্যোগ পরিস্থিতি সফলভাবে মোকাবেলায় সরকারকে শুরু থেকেই কেন্দ্রীয় ও স্থানীয় পর্যায়ের সকল এনজিও নেটওয়ার্ক/প্ল্যাটফর্মকে সাথে নিয়ে একটি যৌথ সমন্বিত কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে।

করোনা সংকট মোকাবেলায় দীর্ঘমেয়াদি প্রকল্প গ্রহণের মাধ্যমে সরকার ও দাতা সংস্থাগুলোর কর্মপরিকল্পনায় স্থানীয় পর্যায়ের বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থাগুলোর সম্পৃক্ততা বাড়াতে হবে এবং কর্মসূচিতে অতি দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য জীবিকায়ন ও সামাজিক সুরক্ষা খাতের আওতা বৃদ্ধি করতে হবে।
বিভিন্ন দুর্যোগে বেসরকারি সংস্থা কর্তৃক সাড়াপ্রদান কার্যক্রম পরিচালনের জন্য সরকার কর্তৃক এবং দাতা সংস্থা কর্তৃক দুটি ভিন্ন তহবিল গঠন করতে হবে।

বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থাগুলোর সক্ষমতা বিবেচনায় প্রযোজ্য ক্ষেত্রে বিশেষকরে টিকা নিবন্ধন কর্মসূচিতে সম্পৃক্ত করা যেতে পারে।

আর্থিক ঝুঁকিতে পড়া স্থানীয় পর্যায়ের সংস্থাগুলোকে টিকে থাকার জন্য সরকার ও দাতা সংস্থা কর্তৃক নীতি সহায়তা ও আর্থিক প্রণোদনা দিতে হবে।

ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠানগুলোকে করোনাকালীন সংকট মোকাবেলায় সহজ শর্তে, স্বল্প সময়ে, কম সুদে ঋণ প্রাপ্তির ধারাবাহিকতার পাশাপাশি ঋণগ্রহীতা সদস্যদের উৎপাদিত পণ্য ন্যায্যমূল্যে বাজারজাতকরণের সুবিধা প্রদান করতে হবে।

কোভিড-১৯ অতিমারী বিশে^র অধিকাংশ দেশের মত বাংলাদেশের স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থা এবং সার্বিক আর্থ-সামাজিক অবস্থাকে এক অভূতপূর্ব সংকটে ফেলেছে।

করোনার বিস্তার মোকাবেলার জন্য আরোপিত সাধারণ ছুটি ও লকডাউন ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসা, ক্ষুদ্রঋণ কর্মকা-, সাধারণ কর্মজীবী ও খেটে খাওয়া মানুষের কর্মসংস্থানসহ সার্বিকভাবে দেশের আর্থ-সামাজিক অবস্থাকে স্থবির ও চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন করেছে। এই অতিমারীর সময়ে দেশের প্রায় ১৫ শতাংশ মানুষ নতুন করে দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমেছে, বিশেষকরে ঝুঁকিগ্রস্ত ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর ওপর করোনার নেতিবাচক প্রভাব ছিল বেশি। এই সংকট মোকাবেলায় ও মানবিক সহায়তায় সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি সংস্থাগুলো উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করে। তবে অতিমারীর প্রাথমিক পর্যায়ে বেসরকারি সংস্থাগুলোকে সরকারি নীতিকৌশল ও কর্মপন্থার সাথে কার্যকরভাবে যুক্ত না করারও অভিযোগ ওঠে।

টিআইবির গবেষণা দলে ছিলেন মোহাম্মদ আব্দুল হান্নান সাখিদার, রিসার্চ অ্যাসোসিয়েটস- কোয়ান্টিটেটিভ, রিসার্চ অ্যান্ড পলিসি, টিআইবি,মো. শাহ্নূর রহমান, রিসার্চ ফেলো (প্রাক্তণ), রিসার্চ অ্যান্ড পলিসি, টিআইবি
মো. শহিদুল ইসলাম, অ্যাসিস্টেন্ট প্রোগ্রাম ম্যানেজার (প্রাক্তণ)- রিসার্চ অ্যান্ড পলিসি, টিআইবি।

গবেষণা উপদেষ্টা ছিলেন ড. ইফতেখারুজ্জামান, নির্বাহী পরিচালক, টিআইবি, প্রফেসর ড. সুমাইয়া খায়ের, উপদেষ্টা, নির্বাহী ব্যবস্থাপনা, টিআইবি,মোহাম্মদ রফিকুল হাসান, পরিচালক, রিসার্চ অ্যান্ড পলিসি, টিআইবি।

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) দুর্নীতি প্রতিরোধ ও সুশাসন প্রতিষ্ঠায় সহায়ক পরিবেশ সৃষ্টির লক্ষ্যে কাজ করছে। এ প্রেক্ষিতে টিআইবি জাতীয় ও স্থানীয় পর্যায়ে জনগুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন খাত ও প্রতিষ্ঠান নিয়ে গবেষণা ও অধিপরামর্শ কার্যক্রম পরিচালনা করে থাকে, যার অংশ হিসেবে বেসরকারি সংস্থার কার্যক্রমে সুশাসনের চর্চা পর্যবেক্ষণ করে আসছে টিআইবি।

এর ধারাবাহিকতায় করোনা সংকট মোকাবেলায় বেসরকারি সংস্থা কর্তৃক গৃহীত উদ্যোগ ও অবদানের ব্যাপ্তি এবং কর্মসূচি বাস্তবায়নে চ্যালেঞ্জ ও শুদ্ধাচার চর্চা পর্যালোচনার উদ্দেশ্যে টিআইবি গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনা করেছে।

সর্বশেষ