নকল ও মেয়াদোত্তীর্ণ ঔষধ চক্রের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চায় পবা
ঢাকা ৪ ডিসেম্বর ২০২১ :
জনসাধারণের স্বাস্থ্য সুরক্ষায় ঔষধ প্রয়োজন। কিন্তু সে ঔষধ যদি জীবন রক্ষার পরিবর্তে ভয়াবহ পরিণতি ডেকে আনে তাহলে দুর্ভোগের সীমা থাকে না। বিশ্ববাজারে যখন বাংলাদেশে উৎপাদিত ঔষধের চাহিদা বেড়ে চলেছে ঠিক তখনই এর বিপরীত চিত্র দেশের ঔষধের বাজারে। দেশীয় বাজারে উৎপাদিত হচ্ছে ভেজাল ও নকল ঔষধ, যার ফলে ক্রমশই অস্থির হয়ে উঠছে ঔষধ শিল্প ও চিকিৎসা ব্যবস্থা।
ভেজাল ও নকল ঔষধ এই শিল্পের উন্নয়ন ও প্রসারে এক বিরাট অশনি সংকেত। পরিসংখ্যান মতে, দেশীয় বাজারে ভেজাল ও নকল ঔষধের বার্ষিক বিক্রয় প্রায় ১.৫ হাজার কোটি টাকার উপর। এই বিরাট অংকের ভেজাল ঔষধের বিক্রি থেকে সহজে অনুমান করা যায় বিশ্ববাজারে বাংলাদেশের উৎপাদিত ঔষধের সুনাম থাকলেও দেশীয় বাজারে চলছে চরম অনিয়ম ও দুর্নীতি।
এইসব ভেজাল ও নকল ঔষধ বাণিজ্যের ফলে সাধারণ মানুষের জীবন বিপন্ন হয়ে পড়ছে। ভেজাল ঔষধের ফলে রোগীর স্বাস্থ্যঝুঁকি ও প্রাণহানির ঘটনাও ক্রমশ বেড়ে চলেছে। এর প্রেক্ষিতে পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন (পবা) সহ সমমনা ১০ টি সংগঠনের যৌথ উদ্যোগে ৪ ডিসেম্বর ২০২১ শাহবাগ জাতীয় জাদুঘরের সামনে “নকল, ভেজাল ও মেয়াদোত্তীর্ণ ঔষধ চক্রের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চাই” দাবীতে মানববন্ধন অনুষ্ঠিত হয়।
বাংলাদেশে ওষুধ শিল্পের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশে মোট উৎপাদিত ওষুধের অন্তত দুই শতাংশ অর্থাৎ প্রতিবছর ৩০০ কোটি টাকার বেশি পরিমাণ অর্থের ভেজাল, নকল এবং নিম্নমানের ওষুধ তৈরি হয়। নামে বেনামে বিভিন্ন কোম্পানী ভেজাল ঔষধ বাজারজাত করে। এইসব ঔষধের লেবেলে কোনো ডিএআর নম্বর নাই। অনেক সময় থাকে না উৎপাদন ও মেয়াদের শেষ তারিখও।
ঔষধ আইন ১৯৪০ ও জাতীয় ঔষধ নীতি ২০১৬ যথাযথ বাস্তবায়ন করতে হবে। প্রয়োজন হলে আইন সংশোধন করে কঠোর শাস্তির বিধান করতে হবে যাতে কেউ এ ধরনের মানবতা বিধ্বংসী কাজ করার সাহস না পায়। প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখার পাশাপাশি ঔষধ শিল্প সমিতিরও এ ব্যাপারে ভূমিকা রাখতে হবে। সুতরাং অভিজ্ঞ ডাক্তারের প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী ভালো কোম্পানির ঔষধ লেবেলের নাম, মূল্য ও মেয়াদ উত্তীর্ণের তারিখ ইত্যাদি দেখে ক্রয় করতে হবে।
দেশে বিভিন্ন সময় পরিচালিত অভিযানে নকল ও ভেজাল ওষুধ উৎপাদনকারীদের গ্রেপ্তার করেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা। কিন্তু তার পরও বন্ধ হচ্ছে না নকল ওষুধ উৎপাদন ও বিক্রি। দুর্বল আইনের কারণে নকল ওষুধ তৈরিতে ভয় পায় না তারা। ড্রাগস আইনে নকল ও ভেজাল ওষুধ উৎপাদনকারীদের সর্বোচ্চ শাস্তির বিধান আছে ১০ বছর কারাদণ্ড।
বিশেষ ক্ষমতা আইনে মৃত্যুদণ্ডের বিধান রয়েছে। তবে মামলা হওয়ার পর তদন্তকারী কর্মকর্তাদের প্রভাবিত এবং আর্থিক শক্তি ব্যবহার করে সবকিছু তাদের অনুকূলে নিয়ে যায়। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নকল ও ভেজাল ওষুধ উৎপাদন এবং বিপণনের সঙ্গে জড়িতরা গণহত্যার মতো অপরাধ করছে। আমরা বলতে চাই, এই গণহত্যা এখনই থামাতে হবে। আমরা দেখতে চাই, নকল ও ভেজাল ওষুধ উৎপাদন ও বিপণনের সঙ্গে জড়িত সব ঘটনার বিচার হচ্ছে, অপরাধীরা সাজা পাচ্ছে এবং সাজা ভোগ করছে।
আইনের ফাঁকফোকর গলে তারা যেন বের হয়ে না আসতে পারে সেটা নিশ্চিত করতে হবে। জনস্বাস্থ্যের মারাত্মক হুমকির জন্য দায়ীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা না নিলে পরিস্থিতি বদলাবে না।
পবা’র সুপারিশসমূহ :
১. অসাধু কোম্পানীর মালিক, ড্রাগ টেস্টিং ল্যাবরেটরী অসাধু কর্মকর্তা এবং ঔষধ ব্যবসার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ী ও চিকিৎসকদের দ্রুত বিচারের মাধ্যমে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করা।
২. সকল ধরনের ঔষধ পরিক্ষা করা নিশ্চিত করতে হবে এবং ফলাফল জনসম্মুখে প্রকাশ করতে হবে।
৩. ভেজাল ঔষধ চেনার এবং পরিহার করার ব্যপারে জনসচেতনতা মূলক কার্যক্রম রেডিও-টিভিতে প্রচার করা।
৪. সারাদেশের বড় বড় মেডিকেলের পার্শ্বে এবং বিভাগীয় শহরগুলিতে এমনকি জেলা শহরে অতি দ্রুত ড্রাগ টেস্টিং ল্যাবরেটরীর স্থাপন করা।
৫. মনিটরিং ব্যবস্থা জোরদার করা। এজন্য সৎ ও উদ্যমী কর্মী ও কর্মকর্তাদের নিযুক্ত করা।
৬. নিবন্ধনকৃত ফার্মেসী ছাড়া অন্য কেউ যেন ঔষধ বিক্রি করতে না পারে সেদিকে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে এবং যে বা যারা বিক্রি করবে তাদের মালিকদের শাস্তির ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে।
৭. ডাক্তারের প্রেসক্রিপশন পরিক্ষা করার ব্যবস্থা করা।
৮. অতিমাত্রায় এন্টিবায়োটিক ঔষধ পরিহারের ব্যপারে নিষেধাজ্ঞা জারি করা এবং তা কার্যকর করা।
পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন (পবা)’র চেয়ারম্যান আবু নাসের খান -এর সভাপতিত্বে ও পবা’র সম্পাদক এম এ ওয়াহেদ এর সঞ্চালনায় উক্ত মানববন্ধনে বক্তব্য রাখেন পবা’র সাধারণ সম্পাদক প্রকৌ. মো. আবদুস সোবহান, মানবাধিকার উন্নয়ন কেন্দ্রের মহা পরিচালক মাহবুল হক, বিডি ক্লিকের সভাপতি আমিনুল ইসলাম টুব্বুস, সামাজিক শক্তির সভাপতি মো: হাবিব উল্লাহ, বাংলাদেশ ট্যুরিস্ট সাইক্লিস্ট এর প্রধান সমন্বয়ক রোজিনা আক্তার, পুরান ঢাকা নাগরিক উদ্যোগ এর সভাপতি নাজিমউদ্দীন, সামাজিক আন্দোলন সংস্থার সভাপতি অধ্যাপক হুমায়ুন কবির হীরু, পরিবেশ উন্নয়ন সোসাইটির সাধারন সম্পাদক মেনন চৌধুরি, দেবীদাস ঘাট সমাজ কল্যাণ সংসদের সভাপতি মো: মুসা, পরিস্কার ঢাকা এর সমন্বয়ক মো: শাজাহান, বাংলাদেশ নিরাপদ পানি আন্দোলনের সভাপতি প্রকৌ: মো: আনোয়ার হোসেন প্রমুখ।
দেশে বর্তমানে প্রায় ৩০০টি ঔষধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান রয়েছে। বর্তমান বাজারমূল্য প্রতিবছর প্রায় ১৭ হাজার কোটি টাকা। বর্তমানে মাত্র ৩% ঔষধ আমদানি করতে হয় আর ৯৭% দেশীয় চাহিদা অভ্যন্তরীণ উৎপাদন থেকেই মেটানো হচ্ছে। দেশের চাহিদা মিটিয়ে ১৫৭ টি দেশে বাংলাদেশ ঔষধ রপ্তানী করে। কিন্তু কিছু লাইসেন্সধারী ও লাইসেন্সবিহীন কোম্পানি অধিক মুনাফার জন্য ভেজাল ঔষধ তৈরি ও বাজার জাত করছে। যা মানুষের যেমনি আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করছে তারচেয়ে বেশি শারীরিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। বিবিসি নিউজে প্রকাশিত তথ্য মতে, বাংলাদেশে বছরে উৎপাদন হয় পঁচিশ হাজার রকমের ওষুধ, এর মধ্যে মাত্র চার হাজার ওষুধ পরীক্ষা করে দেখার সামর্থ্য আছে সরকারের। আর এর দুই থেকে তিন শতাংশ ওষুধ ভেজাল, নকল বা নিম্নমানের। বাকি একুশ হাজার ওষুধ কখনো পরীক্ষাই করা হয় না।