বায়ু দূষণে বাড়ছে স্বাস্থ্যঝুঁকি ও মৃত্যু : পবা
ঢাকা ২৭ নভেম্বর ২০২১ :
শীর্ষ দূষিত নগরীর মধ্যে ঢাকা মহানগরী অন্যতম। বায়ু দূষণের প্রধান উৎস সমূহ প্রায় সকলেরই কমবেশী জানা। যন্ত্রচালিত যান থেকে উৎপন্ন ধোঁয়া, ইটভাটা থেকে নির্গত ধোঁয়া, বিভিন্ন শিল্প কারখানা থেকে নির্গত ধোঁয়া, প্লাস্টিক ও ইলেকট্রনিক্স বর্জ্য প্রসেসিং/পোড়ানো থেকে উৎপন্ন ধোঁয়া এগুলোর মধ্যে অন্যতম।
বর্ষাকালে বৃষ্টির ফলে বায়ু দূষণ কমে যায়, বাতাস চলাচলে দূষিত বায়ু দূরে চলে যায়। ফলে সে সময় বায়ু দূষণ কিছুটা কম থাকে। শীতকালে ইটের ভাটার কার্যক্রমের পরিমান ও দূষণ বৃদ্ধি পায়।
কনস্ট্রাকশন ও রাস্তা খোঁড়াখুড়ির কাজ অনেকাংশে বেড়ে যায়। এ সময় আবহাওয়া শুষ্ক থাকার কারণে ধূলা বাতাসে অনেকক্ষণ উড়ে বেড়ায়। ফলে ধূলা দূষণও অনেক বৃদ্ধি পায়।
অন্যান্য উৎস থেকে ধোঁয়া ও ধূলা একত্র হয়ে ধোঁয়াশার সৃষ্টি করে এবং এই দূষিত বায়ু দীর্ঘক্ষণ একই জায়গায় অবস্থান করে। ফলে অন্যান্য উৎস ধূলা দূষণ একত্রিত হওয়ার ফলে বাতাস দূষণের মাত্রা অত্যাধিক বৃদ্ধি পায়। সরকার ধূলা দূষণ রোধে অনেক পদক্ষেপ গ্রহণ করলেও তা বায়ু দূষণ নিয়ন্ত্রণে পর্যাপ্ত নয়।
সম্প্রতি পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে বায়ু দূষণের কারণে এত ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে যে সেদেশের সরকার স্কুল কলেজ বন্ধ করতে বাধ্য হয়েছে। ঢাকার পরিস্থিতি সে দিকে ধাবিত হচ্ছে বলে আমরা আশঙ্কা প্রকাশ করছি। ফলে বায়ু দূষণের হাত থেকে বাঁচার জন্য সরকারকে দ্রুত কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে।
এর প্রেক্ষিতে ২৭ নভেম্বর ২০২১ জাতীয় জাদুঘরের সামনে পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন (পবা) সহ সমমনা ৯ টি সংগঠনের যৌথ উদ্যোগে “ ধূলা দূষণে বাড়ছে স্বাস্থ্যঝুঁকি ও মৃত্যু-ধূলা দূষণ রোধে চাই কার্যকর পদক্ষেপ” শীর্ষক মানববন্ধন অনুষ্ঠিত হয়।
পবা’র সুপারিশসমূহ :
১. ধূলা সৃষ্টি করে এমন কোন সামগ্রী (বালু, মাটি, ইট, পাথর) বহনের সময় সঠিকভাবে আচ্ছাদনের ব্যবস্থা নেয়া।
২. ভবন নির্মাণ ও মেরামত বা অন্য যে কোন অবকাঠামো নির্মাণের সময় নির্মাণ সামগ্রী ফুটপাত বা রাস্তার উপর বা রাস্তার পাশে খোলা জায়গায় না রাখা।
৩. নালা-নর্দমা পরিস্কার করার পর আবর্জনা রাস্তার পাশে জমিয়ে না রাখা এবং দ্রুততম সময়ে সরিয়ে নেয়া।
৪. সকল আবর্জনা যথাযথ স্থানে ফেলা, সিটি করপোরেশন কর্তৃক আবর্জনা সংগ্রহ ও পরিবহনের সময় সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা যাতে যানবাহন থেকে আর্বজনা রাস্তায় ছড়িয়ে না পড়ে।
৫. রাস্তাঘাট ও ফুটপাত নিয়মিত পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন ও মেরামত করা।
৬. ইট প্রস্তুতে আধুনিক প্রযুক্তি ও লো সালফারযুক্ত কয়লা ব্যবহার করা ।
৭. ধূলা দূষণ নিয়ন্ত্রণে বিদ্যমান আইনসমূহ বাস্তবায়ন এবং সংশ্লিষ্ট সকল কর্তৃপক্ষকে তাদের উপর অর্পিত আইনানুগ দায়িত্ব আন্তরিকতা, নিষ্ঠা, সততা ও স্বচ্ছতার সাথে পালন করা।
৮. সকল অবকাঠামো উন্নয়ন সংস্থা ও কর্তৃপক্ষকে ধূলা দুষণ বন্ধে পদক্ষেপ গ্রহণে পরিবেশ অধিদপ্তরের নির্দেশনা প্রদান।
৯. নির্দেশনা অমান্যকারী কর্তৃপক্ষ বা সংস্থাকে পরিবেশ আইন অনুসারে জরিমানা করা।
১০. ধূলা দূষণ বন্ধে নগরে পর্যাপ্ত গাছ লাগানো।
১১. ধূলা দূষণ ও এর ক্ষতিকর প্রভাব বিষয়ে নাগরিক সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য সরকার ও বেসরকারি সংগঠন, গণমাধ্যম এবং সচেতন মহলের যথাযথ দায়িত্ব পালন করা।
পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন (পবা)’র সাধারণ সম্পাদক প্রকৌ. মো. আবদুস সোবহান -এর সভাপতিত্বে ও পবা’র সম্পাদক এম এ ওয়াহেদ এর সঞ্চালনায় উক্ত মানববন্ধনে বক্তব্য রাখেন পবা’র চেয়ারম্যান আবু নাসের খান, নাসফ-এর সাধারণ সম্পাদক মো: তৈয়ব আলী, পুরান ঢাকা নাগরিক উদ্যোগ এর সভাপতি নাজিমউদ্দীন, নাসফ-এর সহসভাপতি বীরমুক্তিযোদ্ধা কে এম সিদ্দিক আলী, আইন বিষয়ক সম্পাদক মো: ওমর ফারুক, সদস্য ক্যামেলিয়া চৌধুরী, লিয়াকত আলী খান, বাংলাদেশ নদী বাঁচাও আন্দোলন এর প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক হাসিবুল হক পুনম, পরিস্কার ঢাকা এর সমন্বয়ক মো: শাজাহান, মৃত্তিকা এর ব্যবস্থাপক খাদিজা খাতুন, পবা’র সদস্য কবি কামরুজ্জামান ভুইয়া, আলোকিত বন্ধু সংঘের সভাপতি হাজী মো: রনি, গ্রিণফোর্স এর সদস্য ইসমাইল রাকিব প্রমুখ।
বায়ু দূষণের কারণে সারা দেশে মানুষের গড় আয়ু কমেছে প্রায় পাঁচ বছর চার মাস। ঢাকায় কমেছে প্রায় সাত বছর সাত মাস। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ু প্রায় ৭২ বছর ছয় মাস। লাইফ ইনডেক্সের গবেষণা মতে, ১৯৯৮ সালে বায়ু দূষণের কারণে গড় আয়ু কমেছিল প্রায় দুই বছর আট মাস, ২০১৯ সালে সেটি পাঁচ বছর চার মাসে দাঁড়িয়েছে। গবেষণা বলছে, সারা দেশের ৬৪টি জেলার প্রত্যেকটিতেই বায়ু দূষণের হার বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নীতিমালা অনুযায়ী অন্তত তিন গুণ বেশি। দূষিত বাতাসে কঠিন ও তরল পদার্থ উড়ে বেড়ায়, যার মধ্যে রয়েছে কাঁচ, ধোঁয়া বা ধূলা, যেগুলোকে ‘বস্তুকণা’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়।
রাজধানী ঢাকা বিশে^র দ্বিতীয় সবোর্চ্চ দূষিত বায়ুর শহর। ধূলার কারণে এই দূষণের মাত্রা এখন আরও ভয়াবহ। ঢাকা শহরের প্রায় দেড় কোটি মানুষ আসলে এক অবিশ^াস্য বিষাক্ত গ্যাসের মাঝে বাস করছে। নতুন নতুন অবকাঠামোর নামে প্রতিনিয়ত খোঁড়াখুঁড়ির হচ্ছে নগরের বিভিন্ন স্থানে। ফলে ধূলা হয়ে উঠেছে নিত্যসঙ্গী। শুষ্ক মৌসুমে ঢাকা মহানগরীতে ধূলা দূষণের প্রকোপ অত্যন্ত বেড়ে যায়। আমাদের দেশের বিশেষ করে ঢাকা শহরের বায়ুদূষণের অন্যতম কারণ হচ্ছে ইটভাটা, কলকারখানা, নির্মাণকাজ এবং যানবাহনের ধোঁয়া।
অপরিকল্পিতভাবে গ্যাস, বিদ্যুৎ, পানি, ড্রেনেজ এবং রাস্তাঘাট উন্নয়ন, মেরামত ও সংস্কার কার্যক্রমের আওতায় রাস্তা-ঘাট খোঁড়া-খুঁড়ির পরিমান বৃদ্ধি পায়। মেট্রোরেলসহ অন্যান্য মেগা প্রকল্পের জন্য রাস্তা ও আশেপাশের বিশাল এলাকা জুড়ে খোঁড়াখুড়ি, গ্যাস-পানি, বিদ্যুতের লাইন স্থাপনের সময় রাস্তা খোঁড়াখুড়ি, মাটি, বালি, ইটসহ নির্মাণসামগ্রী আচ্ছাদনহীন ট্রাকে করে শহরে পরিবহন করা, ড্রেন পরিস্কার করে রাস্তার পাশে স্তুপ করে রাখা, দোকান পাট ও গৃহস্থালীর আবর্জনা যেখানে সেখানে ফেলে রাখা, মেরামতহীন ভাংগাচোরা রাস্তায় যানবাহন চলাচল, পাকা ভবন নির্মাণের সময় মাটি, বালু, ইটসহ অন্যান্য নির্মাণ সামগ্রী রাস্তা-ফুটপাতে ফেলে রাখা, পুরাতন ভবন ভাঙ্গা, মেশিনে ইট ভাঙ্গা, যানবাহনের কালো ধোঁয়া, শিল্পপ্রতিষ্ঠানের ধোঁয়া, ইত্যাদি ধূলা দূষণের অন্যতম উৎস। এসব উৎস থেকে বিপুল পরিমাণ ধূলা বাতাসে মিশে জনস্বাস্থ্য, পরিবেশ ও অর্থনীতিতে বিরুপ প্রভাব ফেলছে।
যানজট সৃষ্টির পাশাপাশি রাজধানীর বায়ু দূষণেও অন্যতম ভূমিকা পালন করছে ঢাকার রাস্তায় চলাচলকারী অতিরিক্ত যানবাহন। ঢাকা শহরে প্রতিদিন গড়ে প্রায় তিন লাখ যান্ত্রিক যানবাহন চলাচল করে। নগরীতে চলাচলকারী গণপরিবহনের প্রায় সবগুলো বাস-মিনিবাস, প্রাইভেটকার, সিএনজি অটোরিক্সা, টেম্পোসহ গাড়িগুলো মেয়াদোত্তীর্ণ হয়ে পড়েছে, ফিটনেসবীহিন এই সকল গাড়ি থেকে নির্গত ধোঁয়া বায়ু দূষণের জন্য দায়ী।