বজ্রপাত থেকে প্রাণহানি ও ঝুঁকি হ্রাসে নিরাপত্তা পাঠের বিকল্প কম : ড. আশরাফ দেওয়ান

বজ্রপাত থেকে প্রাণহানি ও ঝুঁকি হ্রাসে নিরাপত্তা পাঠের বিকল্প কম : ড. আশরাফ দেওয়ান

 

ঢাকা ০৬ নভেম্বর ২০২১ :

 

বাংলাদেশে বর্তমান সময়ে বজ্রপাতে প্রাণহাণির ঘটনা বেড়েই চলেছে। বজ্রপাতের মৌসুমে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে প্রতিদিনই আসে মৃত্যুর খবর।

বেশিরভাগ সময় বিচ্ছিন্নভাবে এক দুইজনের মৃত্যুর খবর পাওয়া যায়। আবার কখনও কখনও একটিমাত্র বজ্রপাতে বহু মানুষ মারা যাওয়ার ঘটনাও ঘটে থাকে। গত ৪ আগস্ট  চাঁপাইনবাবগঞ্জে বরযাত্রী দলের ওপর বজ্রপাতে ১৭ জনের মৃত্যু হয়েছে।

বজ্রপাতে  শুধু গ্রামের মানুষই মারা যাচ্ছে এমনটি নয়। ৫ জুন ঢাকার মালিবাগে বজ্রপাতের সময় দুই শিশুসহ তিনজন নিহত হয়েছেন। বজ্রপাতে ২০১১ সাল থেকে এ পর্যন্ত গত ১১ বছরে মোট ২ হাজার ৮০০ মানুষের মৃত্যু হয়েছে। চলতি বছর এখন পর্যন্ত ৩২৯ জন মারা গেছেন।

এ বছর মার্চ থেকে জুন মাস পর্যন্ত চার মাসে সারাদেশে বজ্রপাতে ১৭৭ জনের মৃত্যু হয়েছে। একই সময়ে আহত হয়েছেন অন্তত ৪৭ জন। চাঁপাইনবাবগঞ্জ, জামালপুর, নেত্রকোণা ও চট্টগ্রামে বজ্রাঘাতে প্রাণহানি বেড়েছে। তবে হটস্পট হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে সিরাজগঞ্জ।

অর্থাৎ বজ্রপাতে মৃত্যুর হার দিন দিন বেড়েই চলেছে। এমতাবস্থায় পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন (পবা) আজ  অনলাইনে “বজ্রপাতের স্থানিক ও কালিক বিন্যাস, কারণ ও বাঁচার উপায়” শীর্ষক একটি সেমিনারের আয়োজন করে।

পবার চেয়ারম্যান আবু নাসের খানের সভাপতিত্বে ও পবার সম্পাদক এম এ ওয়াহেদের সঞ্চালনায় সেমিনারে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন অস্ট্রেলিয়ার কার্টিন বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল অব আর্থ এন্ড প্ল্যানেটারি সায়েন্সেস এর অধ্যাপক ড. আশরাফ দেওয়ান।

আলোচক হিসেবে বক্তব্য রাখেন সেভ দ্য সোসাইটি এন্ড থান্ডারস্টর্ম এ্যওয়ারনেস ফোরামের সভাপতি ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. কবিরুল বাশার, আরো বক্তব্য রাখেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ড. সুলতানা শফী, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের দুর্যোগ ও জলবায়ু গবেষণা কেন্দ্রের অধ্যাপক ড. মোঃ মনিরুজ্জামান, পবার সাধারণ সম্পাদক প্রকৌঃ মোঃ আবদুস সোবহান,পবার সম্পাদক মেজবাহ সুমন, সদস্য তোফায়েল আহমেদ, কৃষক প্রতিনিধি ইব্রাহীম মিয়া, মানিকগঞ্জ এর যুব সংগঠক মোঃ মিজানুর রহমান, নেত্রকোনার বৃক্ষপ্রেমিক হামিদ কবিরাজ প্রমুখ।

অধ্যাপক ড. আশরাফ দেওয়ান মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন কালে বলেন, দক্ষিণ এশিয়ায় বজ্রপাত অপেক্ষাকৃত নতুন দুর্যোগ। বলা হয় বাংলাদেশে বজ্রপাত ও মৃত্যুর সংখ্যা দিনদিন বাড়ছে। ফলশ্রুতিতে, ২০১৬ সালে সরকার বজ্রপাতকে প্রাকৃতিক দুর্যোগ হিসাবে ঘোষণা করে। বজ্রপাত থেকে প্রাণহানি ও ঝুঁকি হ্রাসে নিরাপত্তা পাঠের বিকল্প কম।

আমাদের এই ওয়েবিনারে বাংলাদেশ ভূখণ্ডে ২০১৫-২০২০ পর্যন্ত আকাশ-থেকে-ভূমিতে সংগঠিত বজ্রপাতের বিশ্লেষণ তুলে ধরা হয়েছে। ভাইসালা’র জিএলডি ৩৬০ নেটওয়ার্কের প্রতিদিনের উপাত্ত ব্যবহার করে স্থানিক ও কালীক বিন্যাস বর্ণনাসহ দিনরাতের বজ্রপাতের হট ও কোল্ড স্পটগুলো বৈজ্ঞানিকভাবে মানচিত্রায়ন করা হয়েছে।

এছাড়া, বজ্রপাত সংঘটনের সাথে ভূপৃষ্ঠের বৈশিষ্ঠাবলীর সম্পর্ক বিশ্লেষণ করা হয়েছে। মূল ফলাফলগুলো হচ্ছে: (১) বাংলাদেশের বজ্রপাত ঋতুভিত্তিক; (২) মধ্যরাত থেকে সকালে বজ্রপাতের পরিমান বেশি এবং মে মাসে সর্বোচ্চ (২৬%) বজ্রপাত হয়; (৩) বজ্রপাতের হট ও কোল্ড স্পটগুলো দিন ও রাত অনুযায়ী পরিবর্তিত হয়; (৪) জলাভূমি ও স্থায়ী জলাশয়গুলোতে দিন ও রাতে বজ্রপাতের সংখ্যা অন্যান্য ভূমির আচ্ছাদনের তুলনায় বেশি; এবং (৫) সুপ্ততাপ প্রবাহ দেশের বজ্রপাতের স্থানিক ও কালিক বিন্যাসকে সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত করে।

২০২১ সালের ০৪ আগস্ট  চাঁপাইনবাবগঞ্জে বরযাত্রা অনুষ্ঠানে ১৬-১৭ জনের এবং ২৩ আগস্ট দিনাজপুরে ৪ বালকের একসাথে মারা যাওয়ার কারণ অনুসন্ধানে দেখা যায় ভূমির বিদ্যুতায়ন এবং পার্শ্ব ঝলকানির দরুন তাদের মৃত্যু হয়। আমাদের দেশে বজ্রপাতের ঘটনা মৌসুম-ভিত্তিক, তাই বার্ষিক উপাত্তের ভিত্তিতে ঝুঁকি হ্রাসের পদক্ষেপ নিলে প্রাণহানির হ্রাসে কার্যকর কিছু হওয়ার সম্ভাবনা কম।

অত্যধিক জনঘনত্ব ও বজ্রপাত মৌসুমে মাঠে-ঘাটে এবং জলাশয়ে বেশি মানুষ কাজে সম্পৃক্ত থাকে বলে সাম্প্রতিককালে মৃত্যু বাড়ছে। তবে বজ্রপাত ও প্রাণহানি বৃদ্ধির অকাট্য প্রমান গবেষণায় পাওয়া যায়নি। এ ক্ষেত্রে অবকাঠামোভিত্তিক সমাধানের পাশাপাশি সচেতনতা বাড়ানোর দিকে সবচেয়ে গুরুত্ব দিতে হবে। স্বল্প মেয়াদে যে কাজটি করা যেতে পারে তা হচ্ছে  স্থানীয় প্রশাসনের মাধ্যমে মানুষকে সচেতন করা আর দীর্ঘমেয়াদে শিক্ষা কার্যক্রমে বজ্রঝড়ের নিরাপত্তায় আবশ্যিক করণীয়সমূহ অন্তর্ভুক্ত করা। কেননা বজ্রপাতকালীন ঘরের ভেতরে থাকলে একরকম আর বাইরে থাকলে অন্যরকম পরিমাপকের প্রয়োজন।

পবার চেয়ারম্যান আবু নাসের খান তার বক্তব্যে বলেন, বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে গবেষণালব্ধ ফলাফলের ভিত্তিতে কার্যক্রম গ্রহণ করলে বজ্রপাতে মৃত্যুসহ ক্ষয়ক্ষতি কমাতে সুফল সবচেয়ে বেশি পাওয়া যাবে। আজকের এই  গবেষণা প্রবন্ধটি পরবর্তী  গবেষণার অন্যতম ভিত্তি হতে পারে।

এই গবেষণালব্ধ ফলাফলগুলি সাইন্টিফিট ডিসকোর্সের ভিত্তিতে সুপারিশসমূহ লাগানো যেতে পারে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নেতৃত্বে দেশ-বিদেশের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্র-শিক্ষকদের সমন্বয়ে একটি বড় গবেষণা হওয়া প্রয়োজন। এই গবেষণা উদ্যোগটি বজ্রপাত ছাড়াও  নানাবিধ গবেষণার সূত্রপাত ঘটাবে এবং বাস্তবভিত্তিক বহু গবেষকের জন্ম দিবে।

বক্তারা বলেন,বজ্রপাত সম্পর্কে সচেতন হলে মৃত্যুর সংখ্যা কমিয়ে আনা সম্ভব। বজ্রপাত থেকে জীবনের সুরক্ষা নিশ্চিতে জনসচেতনতা সৃষ্টি ও করণীয় সম্পর্কে জানাতে সংশ্লিষ্ট বিভাগ ও মূল গণমাধ্যমকে ও সোশ্যাল মিডিয়াকে কাজে লাগাতে হবে। বিশেষ করে বর্ষা মৌসুম শুরুর আগে বজ্রপাত প্রবণ এলাকায় ব্যাপকভাবে জনসচেতনতা কার্যক্রম নিতে হবে।

বক্তারা আরো বলেন, আমাদের সঠিক প্রযুক্তির সহায়তা নিয়ে বজ্রপাতের ভয়াবহতা থেকে রক্ষা থেকে পন্থা অবলম্বন করতে হবে। এর জন্য অরগানাইজড ওয়েতে মুভ করা প্রয়োজন বলে তারা জানান।

সর্বশেষ