সেপ্টেম্বর-অক্টোবর দুই মাসে দেশে সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে ৭০৮টি : রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের প্রতিবেদন

সেপ্টেম্বর-অক্টোবর দুই মাসে দেশে সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে ৭০৮টি : রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের প্রতিবেদন

ঢাকা ০৫ নভেম্বর ২০২১ :

গত সেপ্টেম্বর ও অক্টোবর দুই মাসে দেশে সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে ৭০৮টি।

নিহত ৮৪৬ জন এবং আহত ১০৫৭ জন।

নিহতের মধ্যে নারী ১২১, শিশু ৯২। ৩০৭টি মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় নিহত ৩৪৮ জন, যা মোট নিহতের ৪১.১৩ শতাংশ। মোটরসাইকেল দুর্ঘটনার হার ৪৩.৩৬ শতাংশ। দুর্ঘটনায় ১৯৪ জন পথচারী নিহত হয়েছে, যা মোট নিহতের ২২.৯৩ শতাংশ। যানবাহনের চালক ও সহকারী নিহত হয়েছেন ৯১ জন, অর্থাৎ ১০.৭৫ শতাংশ।

গত সেপ্টেম্বর মাসে ৩৬২ সড়ক দুর্ঘটনায় ৪৩৯ জন নিহত হয়েছিল। অক্টোবর মাসে ৩৪৬ সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছে ৪০৭ জন। এই হিসাবে সেপ্টেম্বরের তুলনায় অক্টোবরে দুর্ঘটনা কমেছে ৪.৪১ শতাংশ এবং প্রাণহানি কমেছে ৭.২৮ শতাংশ।

সেপ্টেম্বর মাসে ১৬৩ মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় ১৮১ জন নিহত হয়েছিল। অক্টোবর মাসে ১৪৪ মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছে ১৬৭ জন। উল্লেখ্য, সেপ্টেম্বরের তুলনায় অক্টোবরে দুর্ঘটনা ও প্রাণহানি সামান্য কমলেও এটি কোনো টেকসই উন্নতির সূচক নির্দেশ করছে না। দুর্ঘটনায় ১৮ থেকে ৬৫ বছর বয়সী কর্মক্ষম মানুষ নিহত হয়েছেন ৬৯২ জন, অর্থাৎ ৮১.৭৯ শতাংশ।

 ট্রাক ও মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা ব্যাপক বৃদ্ধি পেয়েছে। মানসিক ও শারীরিকভাবে অসুস্থ ড্রাইভারদের বেপরোয়া গতিতে ট্রাক চালানো এবং অপ্রাপ্ত বয়স্ক ও যুবকদের বেপরোয়া মোটরসাইকেল চালানোর কারণে তারা নিজেরা দুর্ঘটনায় পতিত হচ্ছে এবং অন্যান্য যানবাহনকে আক্রান্ত করছে। পথচারী নিহতের মাত্রাও চরম উদ্বেগজনক পর্যায়ে। পথচারীরা যেমন সড়কে নিয়ম মেনে চলে না, তেমনি যানবাহনগুলোও বেপরোয়া গতিতে চলে। ফলে পথচারী নিহতের ঘটনা বাড়ছে।

  এই প্রেক্ষাপটে সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ন্ত্রণে সরকারের কোনো উদ্যোগ দৃশ্যমান নয়। “সড়ক পরিবহন আইন-২০১৮” বাস্তবায়নে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের মধ্যে কোনো আগ্রহ দেখা যাচ্ছে না। সড়ক দুর্ঘটনা ঘটছে মূলত সড়ক পরিবহন খাতের নৈরাজ্য ও অব্যস্থাপনার কারণে। এই অবস্থার উন্নয়নে সরকারের রাজনৈতিক সদিচ্ছা প্রয়োজন।

এই সময়ে ১৭টি নৌ-দুর্ঘটনায় ২৮ জন নিহত, ৯ জন আহত এবং ১৫ জন নিখোঁজ রয়েছে। ৩২টি রেলপথ দুর্ঘটনায় ৩৪ জন নিহত এবং ৬ জন আহত হয়েছে।

রোড সেফটি ফাউন্ডেশন ৭টি জাতীয় দৈনিক, ৫টি অনলাইন নিউজ পোর্টাল এবং ইলেক্ট্রনিক গণমাধ্যমের তথ্যের ভিত্তিতে প্রতিবেদনটি তৈরি করেছে।

যানবাহনভিত্তিক নিহতের চিত্র:

দুর্ঘটনায় যানবাহনভিত্তিক নিহতের পরিসংখ্যানে দেখা যায়, মোটরসাইকেল চালক ও আরোহী ৩৪৮ জন (৪১.১৩%), বাস যাত্রী ৫৪ জন (৬.৩৮%), ট্রাক-পিকআপ-কাভার্ডভ্যান-ট্রাক্টর-ট্রলি যাত্রী ৪৯ জন (৫.৭৯%), মাইক্রোবাস-প্রাইভেটকার-এ্যাম্বুলেন্স যাত্রী ১৬ জন (১.৮৯%), থ্রি-হুইলার যাত্রী (ইজিবাইক-সিএনজি-অটোরিকশা-অটোভ্যান-টেম্পু-লেগুনা) ১৪৩ জন (১৬.৯০%), স্থানীয়ভাবে তৈরি যানবাহনের যাত্রী (নসিমন-ভটভটি-আলমসাধু-বোরাক-মাহিন্দ্র-টমটম)৩৩ জন (৩.৯০%) এবং প্যাডেল রিকশা-রিকশাভ্যান-বাইসাইকেল আরোহী ৯জন (১.০৬%) নিহত হয়েছে।

দুর্ঘটনা সংঘটিত সড়কের ধরন:

রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের পর্যবেক্ষণ ও বিশ্লেষণ বলছে, দুর্ঘটনাগুলোর মধ্যে ৩০১টি (৪২.৫১%) জাতীয় মহাসড়কে, ২৩১টি (৩২.৬২%) আঞ্চলিক সড়কে, ১০৫টি (১৪.৮৩%) গ্রামীণ সড়কে, ৬১টি (৮.৬১%) শহরের সড়কে এবং অন্যান্য স্থানে ১০টি (১.৪১%) সংঘটিত হয়েছে।

দুর্ঘটনার ধরন:

দুর্ঘটনাসমূহের ১৬২টি (২২.৮৮%) মুখোমুখি সংঘর্ষ, ২৬৫টি (৩৭.৪২%) নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে, ১৯৬টি (২৭.৬৮%) পথচারীকে চাপা/ধাক্কা দেয়া, ৭২টি (১০.১৬%) যানবাহনের পেছনে আঘাত করা এবং ১৩টি (১.৮৩%) অন্যান্য কারণে ঘটেছে।

দুর্ঘটনায় সম্পৃক্ত যানবাহন:

দুর্ঘটনায় সম্পৃক্ত যানবাহনের মধ্যে- ট্রাক-কাভার্ডভ্যান-পিকআপ ২৫.১১ শতাংশ, ট্রাক্টর-ট্রলি-লরি ৩.৮০ শতাংশ, মাইক্রোবাস-প্রাইভেটকার-এ্যাম্বুলেন্স ৪.৫৯ শতাংশ, যাত্রীবাহী বাস ১৩.৩৫ শতাংশ, মোটরসাইকেল ২৯.১৭ শতাংশ, থ্রি-হুইলার (ইজিবাইক-সিএনজি-অটোরিকশা-অটোভ্যান-লেগুনা-টেম্পু) ১৭.৩২ শতাংশ, স্থানীয়ভাবে তৈরি যানবাহন (নসিমন-ভটভটি-আলমসাধু-মাহিন্দ্র-টমটম-মেসিগাড়ি-আলগানন) ৪.৮৬ শতাংশ এবং প্যাডেল রিকশা-রিকশাভ্যান-বাইসাইকেল ১.৭৬ শতাংশ।

দুর্ঘটনায় সম্পৃক্ত যানবাহনের সংখ্যা:

দুর্ঘটনায় সম্পৃক্ত যানবাহনের সংখ্যা ১,১৩১টি। (ট্রাক ২১৫, বাস ১৫১, কাভার্ডভ্যান ২৬, পিকআপ ৪২, ট্রলি ১৮, লরি ১০, ট্রাক্টর ১২, মাইক্রোবাস ১৬, প্রাইভেটকার ২৭, এ্যাম্বুলেন্স ৭, পুলিশ পিকআপ ২, ড্রাম ট্রাক ২, কার্গো ট্রাক ১, লং ভেহিকেল ১, মোটরসাইকেল ৩৩০, থ্রি-হুইলার ১৯৬(ইজিবাইক-সিএনজি-অটোরিকশা-অটোভ্যান-টেম্পু-লেগুনা), স্থানীয়ভাবে তৈরি যানবাহন ৫৫ (নসিমন-ভটভটি-আলমসাধু-বোরাক-মেসিগাড়ি-মাহিন্দ্র-টমটম-আলগানন) এবং প্যাডেল রিকশা-রিকশাভ্যান-বাইসাইকেল ২০টি।

দুর্ঘটনার সময় বিশ্লেষণ:

সময় বিশ্লেষণে দেখা যায়, দুর্ঘটনাসমূহ ঘটেছে ভোরে ৪.৫১%, সকালে ৩১.৩৫%, দুপুরে ১৮.৭৮%, বিকালে ২০.৩৩%, সন্ধ্যায় ৬.০৭% এবং রাতে ১৮.৯২%।

দুর্ঘটনার বিভাগওয়ারী পরিসংখ্যান:

দুর্ঘটনার বিভাগওয়ারী পরিসংখ্যান বলছে, ঢাকা বিভাগে দুর্ঘটনা ২৫.১৪%, প্রাণহানি ২৩.৭৫%, রাজশাহী বিভাগে দুর্ঘটনা ১৪.১২%, প্রাণহানি ১২.৪১%, চট্টগ্রাম বিভাগে দুর্ঘটনা ১৬.২৪%, প্রাণহানি ১৭.৭৩%, খুলনা বিভাগে দুর্ঘটনা ১২%, প্রাণহানি ১৩%, বরিশাল বিভাগে দুর্ঘটনা ৯.৩২%, প্রাণহানি ৯.৬৯%, সিলেট বিভাগে দুর্ঘটনা ৭.০৬%, প্রাণহানি ৭.০৯%, রংপুর বিভাগে দুর্ঘটনা ৬.৪৯%, প্রাণহানি ৬.৫০% এবং ময়মনসিংহ বিভাগে দুর্ঘটনা ৯.৬০%, প্রাণহানি ৯.৮১% ঘটেছে।

ঢাকা বিভাগে সবচেয়ে বেশি দুর্ঘটনা ও প্রাণহানি ঘটেছে। ১৭৮টি দুর্ঘটনায় নিহত ২০১ জন। সবচেয়ে কম রংপুর বিভাগে। ৪৬টি দুর্ঘটনায় নিহত ৫৫ জন। একক জেলা হিসেবে ময়মনসিংহ জেলায় সবচেয়ে বেশি দুর্ঘটনা ও প্রাণহানি ঘটেছে। ৩৪টি দুর্ঘটনায় ৪৯ জন নিহত। সবচেয়ে কম রাঙ্গামাটি জেলায়। ৩টি দুর্ঘটনা ঘটলেও কেউ হতাহত হয়নি।

আহত ও নিহতদের পেশাগত পরিচয়:

গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্যের ভিত্তিতে জানা যায়, নিহতদের মধ্যে পুলিশ সদস্য ৭ জন, সেনা সদস্য ২ জন, বিমান বাহিনী সদস্য ১ জন, এপিবিএন সদস্য ১ জন, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক ২ জন, স্কুল-কলেজ-মাদরাসার শিক্ষক ২৩ জন, নাটোর জেনারেল হাসপাতালের পরিচালক ১ জন,   পল্লী চিকিৎসক ২ জন, নার্স ১ জন, মেরিন ইঞ্জিনিয়ার ১ জন, এলজিইডি’র ইঞ্জিনিয়ার ১ জন, পশুসম্পদ কর্মকর্তা ১ জন, ভূমি কর্মকর্তা ১ জন, নির্বাচন অফিসের কর্মচারী ১ জন, সাংবাদিক ৬ জন, জেলা ক্রিকেট দলের অধিনায়ক ১ জন, ইমাম ২ জন, এনজিও কর্মকর্তা-কর্মচারী ১৪ জন, ঔষধ ও বিভিন্ন পণ্যসামগ্রী বিক্রয় প্রতিনিধি ২৯  স্থানীয় পর্যায়ের বিভিন্ন ব্যবসায়ী ৩৮ জন, প্রবাসী ১ জন, পোশাক শ্রমিক ১৮ জন, রেল শ্রমিক ২ জন, নির্মাণ শ্রমিক ৬ জন, ইটভাটা শ্রমিক ২ জন, চাতাল শ্রমিক ৩ জন, কাঠমিস্ত্রি ২ জন, লেদমিস্ত্রি ১ জন, রূপপুর বিদ্যুৎ কেন্দ্রের শ্রমিক ১ জন, মানসিক ও শারীরিক প্রতিবন্ধী ৪ জন, ইউপি চেয়ারম্যান-সহ স্থানীয় রাজনৈতিক নেতা ১৭ জন এবং দেশের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ১১৮ জন শিক্ষার্থী নিহত হয়েছে।

দেশে সড়ক দুর্ঘটনার প্রধান কারণসমূহ:

১. ত্রুটিপূর্ণ যানবাহন;

২. বেপরোয়া গতি;

৩. চালকদের বেপরোয়া মানসিকতা, অদক্ষতা ও শারীরিক-মানসিক অসুস্থতা;

৪. বেতন ও কর্মঘন্টা নির্দিষ্ট না থাকা;

৫. মহাসড়কে স্বল্পগতির যানবাহন চলাচল;

৬. তরুণ ও যুবদের বেপরোয়া মোটরসাইকেল চালানো;

৭. জনসাধারণের মধ্যে ট্রাফিক আইন না জানা ও না মানার প্রবণতা;

৮. দুর্বল ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা;

৯. বিআরটিএ’র সক্ষমতার ঘাটতি;

১০ গণপরিবহন খাতে চাঁদাবাজি।

সুপারিশসমূহ:

১. দক্ষ চালক তৈরির উদ্যোগ বৃদ্ধি করতে হবে;

২. চালকের বেতন ও কর্মঘন্টা নির্দিষ্ট করতে হবে;

৩. বিআরটিএ’র সক্ষমতা বৃদ্ধি করতে হবে;

৪. পরিবহনের মালিক-শ্রমিক, যাত্রী ও পথচারীদের প্রতি ট্রাফিক আইনের বাধাহীন প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে;

৫. মহাসড়কে স্বল্পগতির যানবাহন চলাচল বন্ধ করে এগুলোর জন্য আলাদা পার্শ্বরাস্তা (সার্ভিস লেন) তৈরি করতে হবে;

৬. পর্যায়ক্রমে সকল মহাসড়কে রোড ডিভাইডার নির্মাণ করতে হবে;

৭. গণপরিবহনে চাঁদাবাজি বন্ধ করতে হবে;

৮. রেল ও নৌ-পথ সংস্কার ও সম্প্রসারণ করে সড়ক পথের উপর চাপ কমাতে হবে;

৯. টেকসই পরিবহন কৌশল প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করতে হবে;

১০.“সড়ক পরিবহন আইন-২০১৮” বাধাহীনভাবে বাস্তবায়ন করতে হবে।

সর্বশেষ