বিগত লক ডাউনে ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠীর পুনরুদ্ধার প্রক্রিয়া অনেকাংশে বাধাগ্রস্ত হয়েছে : জরিপ

বিগত লক ডাউনে ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠীর পুনরুদ্ধার প্রক্রিয়া অনেকাংশে বাধাগ্রস্ত হয়েছে : জরিপ

বিগত লক ডাউনে ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠীর পুনরুদ্ধার প্রক্রিয়া অনেকাংশে বাধাগ্রস্ত হয়েছে : জরিপ

 

ঢাকা ০৫ নভেম্বর ২০২১ :

 

২০২০ সালের এপ্রিলে দেয়া প্রথম লক ডাউনের ধাক্কা ধীরগতিতে হলেও সামলে উঠছিলো শহরের বস্তিবাসীরা এবং গ্রামবাসীরা। তবে জীবন ও জীবিকা নিয়ে ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (বিআইজিডি) এবং পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টারের (পিপিআরসি) জরিপের চতুর্থ ধাপে উঠে এসেছে কিছুটা ভিন্ন চিত্র।

চলতি বছরের আগস্টে শহুরে বস্তি এবং গ্রাম মিলিয়ে ৪ হাজার ৮৭২ পরিবারের উপর করা জরিপে দেখা গেছে, সর্বশেষ লক ডাউনের ফলে মানুষের স্বাভাবিক জীবনে ফেরার হার বাধাগ্রস্ত হয়েছে। এর আগের ধাপের জরিপগুলো যথাক্রমে ২০২০ সালের এপ্রিল, জুন এবং চলতি বছরের মার্চ মাসে করা হয়েছিলো।

জরিপে দেখা গেছে, এ বছরের মার্চের তুলনায় শহরের বস্তিবাসীর এবং গ্রামবাসীর আয় যথাক্রমে ১৮ এবং ১৫ শতাংশ পর্যন্ত কমেছে, যা পুনরুদ্ধারের ধারার বিপরীত। অধিকাংশের মতে সর্বশেষ লক ডাউনের সিদ্ধান্ত ভালো হলেও জরিপে অংশগ্রহণকারীদের প্রায় অর্ধেকই জানিয়েছেন তাদের জীবিকার সংকটের কথা। স্বল্পশিক্ষিত ও দরিদ্রদের প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ জানিয়েছেন, তারা প্রত্যাশিত কাজ পাননি। প্রথম লক ডাউনে ৪৫ শতাংশ পরিবার সামান্য ত্রাণ পেলেও দ্বিতীয় লকডাউনে সেটি নেমে এসেছে ২৩ শতাংশে।

ফলে, জীবিকার যে পুনরুদ্ধার প্রক্রিয়া চলমান ছিলো, তা কিছুটা ঘুরে গেছে এবং আগস্টে মানুষের আয় করোনার আগের তুলনায় ২৩ শতাংশ কমেছে।

এই আয় কমার হারটা শহুরে বস্তির তুলনায় গ্রামে কিছুটা কম ছিলো – কোভিড-পূর্ব সময়ের তুলনায় তা গ্রামে ১২ শতাংশ কম এবং শহুরে বস্তিতে ৩০ শতাংশ কম। মহামারীর পূর্বে কাজে নিয়োজিত ছিলেন এমন ১০ শতাংশ মানুষ এখনও কোনো কাজ পাননি।

কাজ এবং আয়ের অনিশ্চয়তায় গত ১৮ মাসে মানুষের জীবনযাপনের ঝুঁকি বেড়েছে। জীবনযাপনের জন্য অনেকেই পেশা পরিবর্তনের মাধ্যমে আয়ের চেষ্টা চালিয়েছে।

এমনকি তারা তাদের দক্ষতার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয় এমন কাজেও নিয়োজিত হয়েছিল। যেমন, ১৭ শতাংশ দক্ষ কর্মী উদাহরণ স্বরূপ, ইলেকট্রিশিয়ান – তারা দিনমজুরের মত অদক্ষ কর্মী হিসেবেও কাজ করছেন। মহামারিতে পরিবারগুলোর ঋণের পরিমাণও বেড়েছে ধারাবাহিকভাবে।

মহামারীর পূর্বে অর্থাৎ ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে ঋণের পরিমাণ তাদের বাৎসরিক আয়ের মাত্র ১৩ শতাংশ থাকলেও চলতি বছরের আগস্টে এই হার বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৮ শতাংশে। অনেক পরিবারে মাংস, দুধ, কিংবা ফল খাদ্য তালিকায় থাকছে না এবং তাদের মাথাপিছু খাদ্যব্যয় মহামারীর আগের তুলনায় এখনও কম। ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠী, বিশেষত শিশুদের ওপর এমন অবস্থা দীর্ঘমেয়াদে ক্ষতিকর প্রভাব ফেলতে পারে। শহরের ব্যয় নির্বাহ করতে না পেরে গ্রামে কিংবা তুলনামূলক কম ব্যয়বহুল শহরে চলে যাওয়া ১০ শতাংশ বস্তিবাসী এখনও ফিরে আসেনি।

জরিপে অংশগ্রহণকারী পরিবারগুলোর দারিদ্রের হার মহামারী পূর্ববর্তী সময়ের চেয়ে ১৭%পয়েন্ট উপরে অবস্থান করছে এবং শহুরে বস্তিতে এই হার ২২ শতাংশ। দৈনিক আয়ের ভিত্তিতে বর্তমানে শহরের বস্তির ৭৭ শতাংশ পরিবার দরিদ্র, যা উদ্বেগজনক।

গ্রামের এবং শহুরে বস্তির যেসব ঝুঁকিপূর্ণ পরিবার গড়ে কম আয় করলেও দারিদ্রসীমার উপরে ছিলো, তারা লক ডাউনে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এমন পরিবারের দুই-তৃতীয়াংশই আগস্টে দারিদ্রসীমার নিচে অবস্থান করছে।

এদেরকে বাংলাদেশের ‘নতুন দরিদ্র’ জনগোষ্ঠী হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। আগস্টে জরিপের ফলাফল অনুযায়ী, বর্তমানে জাতীয় জনসংখ্যার ১৯.৫ শতাংশ জনগোষ্ঠী “নতুন দরিদ্র”। যা ২০২১ সালের মার্চে অনুমিত ধারণার চেয়ে ৫ শতাংশ পয়েন্ট বেশি।

গবেষনায় আরও কিছু তথ্য উঠে এসেছে। অনেক “নতুন দরিদ্র” পরিবার দীর্ঘমেয়াদী দারিদ্রে পড়তে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। মহামারী আসার পর দারিদ্রসীমার উপরে অবস্থানরত অন্তত ২৯ শতাংশ পরিবার দরিদ্র হয়ে পড়ে। সেই থেকে তারা নিজেদের অবস্থান এখনও উন্নত করতে পারেনি। দীর্ঘমেয়াদী এই দারিদ্রের কারণে পরিবারগুলোর স্বাভাবিক জীবিকা ব্যহত হতে পারে এবং তারা দারিদ্রের দুষ্টচক্রে পড়তে পারে।

“আমাদের এই অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে এবং স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে যেতে হবে। আমরা ইতোমধ্যেই দেখতে পেয়েছি অনেকেই বিভিন্নভাবে পুনরুদ্ধার করেছে এবং মানিয়েও নিয়েছে। এক্ষেত্রে বিশেষত নতুন দরিদ্ররাই রয়েছে যাদের দীর্ঘমেয়াদী দারিদ্রের কবলে পড়ার ঝুঁকি সবচেয়ে বেশি। আমাদের অবশ্যই পুনরুদ্ধারে পিছিয়ে পড়ার দিকে এখনই নজর দিতে হবে।“ বিআইজিডি’র নির্বাহী পরিচালক ডঃ ইমরান মতিন তাঁর বক্তব্যে বলেন।

ডঃ হোসেন জিল্লুর রহমান জানান, “নতুনভাবে সংক্রমনের ঢেউ আসার হুমকি এখনও বিদ্যমান। স্বাস্থ্যসেবা, প্রশাসনিক এবং অর্থনৈতিক নীতিমালার সমন্বয়ে একটি সার্বিক পদক্ষেপ না নেয়া হলে কিছুতেই এ ক্ষতি কমিয়ে আনা সম্ভব নয়। কোভিডে ক্ষতিগ্রস্থদের সাহায্যে সামাজিক ন্যায়বিচার একটি মৌলিক প্রশ্ন। কোনো ধরণের নীতি তৈরি না করেই বা, সামান্য কিছু সাহায্য করেই সমাজের সুবিধাবঞ্চিত শ্রেণীর মানুষদের এ অবস্থায় রাখা যাবে না। শহরে বড় আকারের সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী, সিএসএমই পুনরুদ্ধারে বাজেটসমৃদ্ধ পরিকল্পনাকে গুরত্ব দিতে হবে। একইসাথে, স্বাস্থ্যসেবায়, শিক্ষায়, যাতায়াতে ও দৈনন্দিন জীবনে ব্যয়বৃদ্ধিকে মাথায় রেখে সামষ্টিক নীতিমালা তৈরির দিকে নজর দিতে হবে। শুধু তাই নয়, এর সাথে সাথে টিকাদানের কার্যকারিতা ও সচেতনতাও বাড়ানোকেও সমানভাবে গুরুত্ব দিতে হবে।”

৪ নভেম্বর, বৃহস্পতিবার, বিআইজিডি- পিপিআরসি আয়োজিত এক ওয়েবিনারে জরিপের ফলাফলগুলো তুলে ধরা হয়েছে।

সর্বশেষ