রক্ষণাবেক্ষণের অজুহাতে পার্ক ও খেলার মাঠগুলোকে আবদ্ধ করে দিচ্ছি : খোন্দকার এম আনসার হোসেন
ঢাকা নভেম্বর ০২ ২০২১ :
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্স (বি.আই.পি.) এর উদ্যোগে এবং জার্মান এজেন্সী ফর ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন (জিআইজেড) বাংলাদেশ এর সহযোগিতায় Planning for Inclusiveness and Sustainability in Post Pandemic Era (মহামারী পরবর্তী কালে অন্তর্ভূক্তিতা ও স্থায়িত্বশীলতার জন্য পরিকল্পনা) প্রতিপাদ্যকে সামনে রেখে বিগত ৩০ অক্টোবর ২০২১ তারিখ থেকে সপ্তাহব্যাপী চলমান নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিষয়ক আন্তর্জাতিক সম্মেলন (আইকার্প) ২০২১ এর “পঞ্চম ভার্চুয়াল অধিবেশনঃ গণপরিসর এবং বিনোদন এলাকার পূনঃপরিকল্পনা” ২ নভেম্বর ২০২১ তারিখে ভার্চুয়াল জুম প্লাটফর্মে অনুষ্ঠিত হয়। অধিবেশনটি বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্স (বি.আই.পি.) এর অফিসিয়াল ইউটিউব চ্যানেল এবং ফেসবুক পেইজ থেকে সরাসরি সম্প্রচার করা হয়।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্স (বি.আই.পি.) এর সাবেক সাধারণ সম্পাদক পরিকল্পনাবিদ খোন্দকার এম আনসার হোসেন এর সঞ্চালনায় এবং সভাপতিত্বে এই অধিবেশনে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন ইউএন হ্যাবিটেট এর পাবলিক স্পেস প্রোগ্রাম এর প্রধান মি. জশ ছেং। উক্ত সেমিনারে আলোচক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের সভাপতি অধ্যাপক ড, হালিমা বেগম এবং ওয়ার্ক ফর বেটার বাংলাদেশ এর সিনিয়র প্রকল্প কর্মকর্তা মোঃ জিয়াউর রহমান। এছাড়াও অধিবেশনের মনোনীত প্রবন্ধ হিসেবে Regeneration of Historic Katras: Integration into Dhaka’s Urban Fabric প্রবন্ধটি উপস্থাপন করেন রশিদ আনজুম আদিল, এবং People-Centric Public Space through Documenting Public Life: A Case of Sheikh Kamal Soroni প্রবন্ধটি উপস্থাপন করে মারজুকা সালেহ।
মূল প্রবন্ধ উপস্থাপনায় জশ চং দক্ষিণ এশিয়া এবং বাংলাদেশের গণপরিসর ও বিনোদন কেন্দ্রর গুণগত মান ও গুরুত্বের কথা তুলে ধরেন। একইসাথে, দক্ষিণ এশিয়ায় বিনোদন কেন্দ্র বাড়ানো ও পুনরায় গঠনের দরকার বলে মনে করেন তিনি।
এছাড়া তিনি খোলা জায়গা, গণপরিসর এর গুরুত্ব, গণপরিসরের স্বল্পতা এবং গণপরিসর কিভাবে বাড়ানো যায় সে বিষয়ে আলোকপাত করেন। এছাড়াও তিনি গ্লোবাল এজেন্ডা, নিউ আরবান এজেণ্ডা এর উপাদান, মূলনীতি প্রভৃতি নিয়ে আলোচনা করার সাথে স্যাটেলাইট ইমেজ উন্নয়ন বিষয়ক প্রস্তাব করেন।
রাশিদ আঞ্জুম আদিল তার উপস্থাপনায় পুরান ঢাকার ঐতিহাসিক কাটরাগুলোকে পুনরায় গঠনের মাধ্যমে ঢাকার নগর কাঠামো একত্রিত করার কথা বলেছেন এবং তার প্রবন্ধে নগর কাঠামো গঠন সম্পর্কিত বিশদভাবে আলোচনা করেন। তিনি আরও উল্লেখ করেন ঐতিহাসিক স্থাপনা পুরুদ্ধারের মাধ্যমে নগর কাঠামো গঠন কঠিন, তবে সুপরিকল্পিত পন্থায় এই সমস্যার সমাধান হতে পারে বলে তিনি মন্তব্য করেন।
অধিবেশনের আরেক প্রবন্ধ উপস্থাপক মারজুকা সালেহ তার গবেষণায় কামাল সরণীর উদাহরণের মাধ্যমে ঢাকা শহরের জনসাধারণ কেন্দ্রিক গণপরিসরের পরিস্থিতি তুলে ধরেন। তিনি বলেন, ঢাকায় গণপরিসরের পরিমাণ অতি নগণ্য এবং এগুলো পুরোপুরি ব্যবহারযোগ্য বা সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত নয়। বেশিরভাগ পার্ক, খেলার মাঠ কিংবা রাস্তা অপ্রয়োজনীয় বেষ্টনী দিয়ে আবদ্ধ কিংবা যানবাহন ও নির্মাণ সামগ্রী দিয়ে আচ্ছাদিত। কাজেই এসব এই গণপরিসরগুলি শিশুদের চেয়ে মধ্যবয়সী লোকেরা বেশি ব্যবহার করে।
অধিবেশনের বিশেষ আলোচক জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. হালিমা বেগম সবাইকে সাধুবাদ জানিয়ে তার মতামত প্রকাশ করেন। তিনি প্রবন্ধ উপস্থাপক মারজুকা সালেহ এর সাথে একাত্মতা প্রকাশ করে বলেন, যদিও স্থানীয় সরকার অনেক এলাকায় কিছু গণপরিসর তৈরি করেছে, সেগুলোর বেশিরভাগই সাধারণ মানুষের জন্য সুগম নয়। বিশেষ করে নারী ও শিশুরা নিরাপত্তাহীনতা ও আরো আনুষাঙ্গিক কারণে এসব পার্ক ও খেলার মাঠে যায় না। তিনি বলেন, পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের সময় এই সমস্যাগুলো আমাদের চিহ্নিত করতে হবে এবং সমাধান করতে হবে ।
আলোচক জিয়াউর রহমান বাংলাদেশে পাবলিক স্পেসের অপ্রতুলতার প্রতি ইঙ্গিত করে বলেন, আমাদের দেশে একটি প্রধান সমস্যা হলো, আমরা যেকোনো পার্ক কিংবা খেলার মাঠ তৈরি করার সময় আমাদের সাধারণ মানুষদের জড়িত করি না। এমতাবস্থায় বেশিরভাগ সময়েই তাদের সমস্যা এবং চাহিদাগুলো চিহ্নিত হয় না। এসময় তিনি উল্লেখ করেন, ওয়ার্ক ফর বেটার বাংলাদেশ, ডিএনসিসি এবং ইউএন হ্যাবিট্যাটের সহযোগিতায়, অংশগ্রহণমূলক পদ্ধতিতে ঢাকা শহরে ৫টি পাবলিক স্পেস তৈরির কাজ করছে। তিনি তার আলোচনায় জনসড়কগুলোতে অর্ধেকের ও বেশি জায়গাজুড়ে পার্ক করে রাখা বিভিন্ন ধরনের যানবাহন দ্বারা সৃষ্ট যানজটের কথাও উল্লেখ করেন।
অধিবেশনের প্রশ্নত্তোর পর্বে, নগর পরিকল্পনাবিদ অধ্যাপক গোলাম রহমান পুরান ঢাকার রিডেভেলপমেন্টের প্রতি মনোনিবেশ করেন এবং পুরান ঢাকার গতি নিয়ন্ত্রণের জন্য সকল নদী ঘাটগুলো খুলে দিয়ে জলপথে সংযোগ নিশ্চিত করার পরামর্শ দেন। তিনি আরও বলেন, পুরান ঢাকার সমস্যা নিরসনে রাজউক ও পৌর কর্তৃপক্ষের উচিত ওয়ার্ডভিত্তিক পরিকল্পনা তৈরি করা।
সমাপণী বক্তব্যে অধিবেশনের সভাপতি এবং সঞ্চালক পরিকল্পনাবিদ খোন্দকার এম আনসার হোসেন বলেন, পাবলিক স্পেসের এই অপ্রতুলতার এবং অব্যবহারযোগ্যতার জন্য আমরা সাধারণ মানুষও আংশিকভাবে দায়ী কারণ আমরা এর প্রতিবাদ করছি না।
তিনি বলেন, রক্ষণাবেক্ষণের অজুহাতে আমরা আমাদের পার্ক ও খেলার মাঠগুলোকে আরও আবদ্ধ করে দিচ্ছি এবং বিভিন্ন শ্রেণীর মানুষের মধ্যে বৈষম্য তৈরি করছি। অধ্যাপক গোলাম রহমানের মতের সাথে সম্মত হয়ে তিনি আরও বলেন, পুরাতন ঢাকার রিডেভেলপমেন্টের সময় আমাদের সতর্ক থাকতে হবে যাতে এর ঐতিহাসিক মর্যাদা অক্ষুন্ন থাকে। পুরানো ভবনগুলোকে ভেঙে নতুন আধুনিক ভবন নির্মাণের পরিবর্তে, পর্যটকদের আরো আকৃষ্ট করার জন্য আমাদের উচিত এর পুরানো সৌন্দর্য সংরক্ষণ ও প্রচার করা উচিত বলেও তিনি মন্তব্য করেন।